স্টাফ রিপোর্টার: লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে পানিতে ভাসছে জাহাজ। ওসব জাহাজে রমজান উপলক্ষে আমদানি করা ডাল, চিনির কাঁচামাল ও গমসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। মূলত রোজায় বাজার অস্থিরতা সৃষ্টি করে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতেই অসাধু ব্যবসায়ি চক্র জাহাজকে গুদাম বানিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয পণ্য সাগরে ভাসিয়ে রেখেছে। যদিও লাইটারেজ জাহাজের মালিকরা বলছেন, ঘাটে পণ্য নামানোর সুযোগ না পাওয়ার কারণেই খালাসের জন্য ওভাবে পণ্য নিয়ে ওসব জাহাজ অপেক্ষা করছে। বিগত এক মাস ধরে দেশের ৫৬টি ঘাটে ভাসছে ১৫ লাখ টন পণ্যবাহী সাড়ে ১২শ’ জাহাজ। এ অবস্থায় পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙরে লাইটারেজ জাহাজের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আর তার প্রভাব পড়ছে বন্দরের বহির্নোঙরে কার্যক্রমও। অথচ এক দিন অতিরিক্ত অপেক্ষার জন্য বহির্নোঙরে বিদেশি জাহাজগুলোকে প্রতিদিন বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে ৮ লাখ টাকা করে। তাতে বহির্বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের সুনামও ক্ষুণœ হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের ৫৬টি ঘাটে পণ্য নিয়ে ভাসছে এক হাজার ২৫১টি জাহাজ। ওসব জাহাজে ডাল, গম, চিনির কাঁচামাল, ভুট্টা, সার, সিমেন্ট ক্লিঙ্কার, পাথর, লাইমস্টোন, ড্যাপসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে ১৫ লাখ ২৬ হাজার ২৩৪ টন। রোজায় দাম নিয়ে কারসাজি করতেই ব্যবসায়িদের একটি অংশ ওভাবে পণ্য ভাসিয়ে রেখেছে সাগরে। সাধারণভাবে একটি লাইটারেজের পণ্য খালাস করতে ৮ থেকে ১০ দিন লাগার কথা। কিন্তু এসব জাহাজ সাগরে ভাসছে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। এই প্রবণতা বন্ধ করা না গেলে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থির করার সুযোগ বাড়ছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের নদীতে ১৩৭টি লাইটারেজ জাহাজে ভাসছে ২ লাখ ১ হাজার ৬৫০ টন পণ্য। তাছাড়া প্রায় ১৩ হাজার টন পণ্য নিয়ে এস আলম ঘাটে ১১টি, ৩ হাজার ৯০০ টন নিয়ে চট্টগ্রাম সাইলোতে দুটি, ১ হাজার টন পণ্য নিয়ে বাঁশখালীতে একটি, ৭৭ হাজার ৯৫৪ টন নিয়ে বাঘাবাড়ীতে ৮৮টি, ৪০ হাজার ৯৩০ টন নিয়ে নগরবাড়ীতে ৫৪টি, ২ লাখ টন নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ১৩৬টি, ৬৩ হাজার টন নিয়ে আলীগঞ্জ নিতাইগঞ্জে ৩৮টি, ৩ হাজার টন নিয়ে এমআই সিমেন্ট ঘাটে ২টি, ৬ হাজার টন নিয়ে বসুন্ধরায় ৩টি, সাড়ে ৯ হাজার টন নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ ঘাটে ৫টি, ১০ হাজার ৮০০ টন পণ্য নিয়ে শিকারপুরে ১২টি, ৪০ হাজার টন নিয়ে মিরপুরে ৪১টি, ২১ হাজার টন নিয়ে ধর্মগঞ্জে ১৪টি, ১২ হাজার টন নিয়ে লাফার্জ এসকো ঘাটে ৮টি, ২৯ হাজার টন নিয়ে ধাপা ঘাটে ২১টি, ১৩ হাজার টন নিয়ে আনোয়ার সিমেন্ট ঘাটে ৮টি, ৪০ হাজার টন নিয়ে মেঘনা ঘাটে ৩১টি, ৭ হাজার টন নিয়ে সেভেন সার্কেলে ১২টি, ২৪ হাজার ৪০০ টন নিয়ে মাদ্রাসা ঘাটে ১৬টি, ৮২ হাজার ৯৫০ টন পণ্য নিয়ে শাহ সিমেন্ট ঘাটে ৪৮টি, ৬ হাজার ৭৫০ টন নিয়ে পায়রা বন্দরে ৬টি, ৪৯ হাজার টন নিয়ে পাগলা ঘাটে ৩০টি, ৬ হাজার ৯৬৫ টন পণ্য নিয়ে এহসান সিমেন্ট ঘাটে ৭টি জাহাজ ভাসছে। একইভাবে লাফার্জ ছাতক ঘাটে ৬, ভৈরব ঘাটে ৩৪, আশুগঞ্জে ৩২, ঝালকাঠিতে ২২, মংলা ঘাটে ২৩, নোয়াপাড়ায় ৯৫, বরিশালে ৩৬, ইটিএ ঘাটে ৬, রামপাল ঘাটে ১, ফরিদপুর সি অ্যান্ড বি ঘাটে ১২, আকিজ সিমেন্ট ঘাটে ১২, শিরোমনি ঘাটে ২২, মাওয়া ঘাটে ২১, স্ক্যান সিমেন্ট ঘাটে ১২, কাঞ্চন ঘাটে ১৯, কমলনগরে ৫, সিটি গ্রুপ ঘাটে ১৭, দেশবন্ধু ঘাটে ১৮, হোলসিম মেঘনা ঘাটে ১১, ঘোড়াশালে ১৮, অলিম্পিক সিমেন্ট ঘাটে ১০, বেঙ্গল টাইগার ঘাটে ২০, ডেমরা ঘাটে ১৭, আমান কাঞ্চন ঘাটে ৫টি, আমান মেঘনা ঘাটে ৮, পিরোজপুরে ৩, মোক্তারপুর ঘাটে ১৬, পলাশ ঘাটে ১, মেট্রো সিমেন্ট ঘাটে ৪, সিয়াম সিটি ঘাটে ১২, মীর সিমেন্ট ঘাটে ১ ও পটুয়াখালী ঘাটে অপেক্ষা করছে ১টি লাইটারেজ জাহাজ।
সূত্র জানায়, কর্ণফুলী নদীর নাব্য সমস্যার কারণে বন্দরের বহির্নোঙরে আসা বিদেশি জাহাজ লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে কিছু পণ্য খালাস করে বন্দরের জেটিতে নোঙর করে। তাছাড়া লাইটারেজ জাহাজগুলো ওই পণ্য নিয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও। এভাবে পণ্য খালাসের কাজে নিয়োজিত আছে মাত্র ২০টি লাইটারেজ জাহাজ। আর বিগত ১৪ মে থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে চলমান আছে পণ্যবাহী আরো ৩০টি লাইটারেজ। পরবর্তী বুকিংয়ের জন্য সিরিয়ালে আছে ৩৭টি, মেরামতের জন্য ডকিংয়ে আছে ১০৮টি। এভাবে ১৯৫টি লাইটারেজ জাহাজ ব্যবহার পর্যায়ে থাকলেও গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এক হাজার ২৫১টি জাহাজ। বন্দরের বার্থিং লিস্ট অনুযায়ী লাইটারেজ না পাওয়ায় ১৫ দিনেও পণ্য খালাস করতে পারেনি সিটি গ্রুপের ৫৫ হাজার ৬০০ টন গম নিয়ে আসা এমভি সেরেনি জেমিকাস নামের জাহাজটি। একই অবস্থা মেঘনা গ্রুপের ৫৬ হাজার ৩০০ টন গম নিয়ে ২৪ এপ্রিল আসা জাহাজ এভার সাকসেস-এরও। ২৯ এপ্রিল আসা এমভি জেমেনি নামের জাহাজও অপেক্ষা করছে এখনও।
এদিকে এ প্রসঙ্গে জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিভোয়া) সাধারণ সম্পাদক নূরুল হক জানান, কিছু জাহাজ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ভেসে থাকার বিষয়টি সত্য। পণ্যের মালিকরা বলছেন, ঘাটে নামানোর সুযোগ না পাওয়াতেই এভাবে তা জাহাজে ভাসিয়ে রেখেছেন তারা। তবে জাহাজ মালিকরা এ কথা বিশ্বাস না করে পণ্য দ্রুত খালাস করতে চাপ দিচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হবে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম জানান, লাইটারেজ জাহাজের কার্যক্রমের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরে আসা খোলা পণ্যের ৭০ শতাংশেরও বেশি খালাস হয় বহির্নোঙরে। বেশি ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ লাইটারেজের মাধ্যমে বহির্নোঙরে কিছু পণ্য খালাস করে বন্দরের জেটিতে নোঙর করে। পর্যাপ্ত লাইটারেজ না থাকলে বিদেশি জাহাজগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন। তাতে তাদের পরিচালন ব্যয় বাড়ে।
< Prev | Next > |
---|