siting offস্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ হয়নি। যাত্রীদের জিম্মি করলে রুট পারমিট বাতিল করা হবে বলে বিআরটিএ বাস মালিকদের হুঁশিয়ার করলেও ঢাকাবাসীর দুর্ভোগের চিত্র পাল্টায়নি। রাজধানীতে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধের পর দ্বিতীয় দিনেও মালিকরা গাড়ি কম নামিয়ে সড়কে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।

বাস ভাড়া নিয়ে রাজধানীজুড়ে বাসে বাসে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের কথাকাটাকাটির পাশাপাশি টানাহেঁচড়ার ঘটনাও ঘটছে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে নারী ও শিশুদের। তবে, কোথাও কোথাও কম ভাড়া নেওয়ার খবর জানা যাচ্ছে।

পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, মালিকের ভাড়ার টাকা পরিশোধ করে জীবনধারণ করতে হলে আগের ভাড়াই নিতে হবে। অন্যদিকে যাত্রীরা অভিযোগ করছেন, এখন অতিরিক্ত ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু ঝামেলাও যুক্ত হয়েছে, যেমন- আজ (গতকাল সোমবার) রাজধানীতে বাস কমে গেছে, বাসগুলো অকারণে বিভিন্ন বাসস্টপে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলে সময়ক্ষেপণ করছে, এতে অফিসগামী যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। বচসার কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এদিকে, সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে গতকাল সোমবার দ্বিতীয় দিনের মতো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এ সময় বাড়তি ভাড়া আদায়, বাসে সরকার নির্ধারিত কিলোমিটারপ্রতি ভাড়ার তালিকা না টাঙানোসহ নানা কারণে শতাধিক গণপরিবহনের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সকাল থেকে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ, আগারগাঁও, রমনা, মিরপুরসহ মোট পাঁচটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিআরটিএ। যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন। অভিযানের দ্বিতীয় দিন কিছুকিছু গণপরিবহন বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধ করেছে বলে জানান যাত্রীরা। তবে বেশির ভাগ বাস তাদের সিটিং সার্ভিস তুলে দিলেও ভাড়া আদায় করছে আগের মতোই।

বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ও বাস মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, গণপরিবহনে যাত্রী হয়রানি বন্ধসহ সব ধরনের অনিয়ম দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়াসহ সব রকম নৈরাজ্য দূর করতে পর্যায়ক্রমে জরিমানাসহ শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হবে বলেও জানানা তাঁরা। বিআরটিএর নির্বাহী হাকিম মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, একটি বাসে ভাড়া অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে। তার ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি বাসে ভাড়ার চার্ট (তালিকা) টাঙানো না থাকায় পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ন কবির বলেন, নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সপ্তাহে তিন দিন অভিযান পরিচালনা করা হবে। আর বিআরটিএ নিয়মিত অভিযান চালাবে।

গণপরিবহনের যাত্রীদের বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখে ভাড়া দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদিকে কারওয়ান বাজারে হাজি পরিবহনের বাস থেকে নামা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যাত্রী সকালে জানান, তিনি মিরপুর-১২ থেকে কারওয়ান বাজারে আসেন প্রতিদিন। আজও আগের টাকাই নিয়েছে বাস কর্তৃপক্ষ। তবে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের দুই টাকা কম দিতে হয়েছে। কিন্তু আগে বাস যে সময়ে কারওয়ান বাজার আসত, আজ এর থেকে ১৫ মিনিট বেশি সময় লেগেছে।

কারণ, বাস বিভিন্ন স্টপে থেমেছে এবং যাত্রী তুলেছে। ওই যাত্রী আরো জানান, বাসে ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বচসা হচ্ছে। সকাল বেলায় অফিস যাওয়ার পথে এটা আরেকটা ঝামেলা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন যাত্রী জানান, রাস্তায় বাস অনেক কমে গেছে। হঠাৎ করেই সকালে বাস কমে যাওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। অফিস সময়ে অকারণে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বাসে উঠতে নাকাল হচ্ছেন যাত্রীরা। তবে সাভার থেকে ফার্মগেটে আসা এক যাত্রী জানালেন, তাঁর অভিজ্ঞতা ভালো। তিনি লোকাল বাসে এসেছেন, লোকাল ভাড়াই দিয়েছেন। রাস্তায় বাস কম থাকায় আসতেও সময় লেগেছে কম। গতকাল সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে বাসের সংখ্যা রোববারের মতই কম। ‘সিটিং সার্ভিস’ ব্যবস্থা উঠে গেলেও বিভিন্ন রুটের বাসে এখনও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৪ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে ১৫ এপ্রিলের পর থেকে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধের ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।

এরপর শনিবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বন্ধে গত রোববার থেকে অভিযান চালানোর কথা জানায়। গত রোববার সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরুর পর অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বচসা-মারামারির ঘটনা ঘটে বিভিন্ন স্থানে। অনেক মালিক রাস্তায় গাড়ি না ছাড়ায় যাত্রীরা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন। বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান গতকাল সোমবার বলেন, কোনো পরিবহন কোম্পানি তাদের গাড়ি বন্ধ রাখলে রুট পারমিট বাতিল করে দেওয়া হবে।

তারা গাড়ির রুট পারমিট নিয়েছে যাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য। এখন যদি কেউ গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি সৃষ্টি করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।

তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে। কিন্তু গতকাল সোমবারও বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, বাসের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। বাস না পেয়ে বিভ্ন্নি মোড়ে যানবাহনের আশায় দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। নারী যাত্রীদের ভুগতে হচ্ছে অনেক বেশি। সকালে কালশী মোড়ে এক ঘণ্টা বাসে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন মালতী রাণী দাশ।

তিনি বলেন, গাড়িতে উঠতে পারতেছি না। গাড়ি যে কয়টা আসছে পুরুষ যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে উঠল, আমরা আর উঠতে পারি না। যমুনা ফিউচার পার্কের দোকান কর্মচারী আনিসুর রহমান জানান, কাজে যাওয়ার জন্য সকালে পূরবী থেকে অছিম পরিবহনের বাসে ওঠেন তিনি। গত রোববার তার কাছ থেকে ‘সিটিং ভাড়া’ ২৫ টাকা নেওয়া হলেও গতকাল সোমবার ‘লোকাল ভাড়া’ ১৮ টাকা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস কম থাকায় ভোগান্তি ঠিকই হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের কথা-কাটাকাটির ঘটনা চোখে পড়েছে গতকাল সোমবারও।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কালশী মোড়ে গ্যালাক্সি পরিবহনের চালকের সহকারী যাত্রীদের সঙ্গে বিত-ার পর গাড়ি থেকে নেমে যান। এ অবস্থায় যাত্রীভর্তি বাসের চালকও সহকারী ছাড়া যেতে অস্বীকৃতি জানান। বাসের চালক রাসেল মিয়া বলেন, মিরপুর ১১ নম্বর থেকে কাকলীর ভাড়া ১৮ টাকা। কিন্তু কেউ ১০ টাকা দেয়, কেউ ১৫ টাকা দেয়। হেলপারকে মারার পর হেলপার পালাইছে, আমি কেমনে যাব? পরে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে ইসিবি চত্বর থেকে ভাড়ার চার্ট নিয়ে সে অনুযায়ী ভাড়া আদায়ের রফা করলে বাস গন্তব্যে ছেড়ে যায়। সকাল ৯টার দিকে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় দেখা যায়, মিরপুর থেকে বাস নিয়ে কুড়িল এসে আর যেতে চাইছেন না চালকরা। কারণ জানতে চাইলে আকবর আলী নামে একজন চালক অভিযোগ করেন, যাত্রীরা ভাড়া ‘ঠিকমতো’ দেয় না। উল্টো ‘মারপিট করে’।

আগে মিরপুর থেকে মহাখালী পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া আছিল। অহনও চার্টে ২২ টাকা ভাড়া আছে। কিন্তু যাত্রীরা দিবার চায় না। ১৫ টাকা দ্যায়, আবার অনেকে ১০ নম্বর থাইকা মহাখালী পর্যন্ত ১০ টাকা ভাড়া দেয়। সুপারভাইজার তো ওয়েবিলে ২০ ট্যাকা লেইখা দেয়। বাকি ট্যাকা আমি কইত্থন দিমু? কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় কথা হয় খিলক্ষেত থেকে আগারগাঁও রুটের যাত্রী সূর্যদেব সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সিটিং ভাড়া আদায় একটু কমেছে। আগে খিলক্ষেত থেকে আগারগাঁও ৩০ টাকা ছিল, আজকে পঁচিশ টাকা নিয়েছে।

কিন্তু বাস কম, যাত্রী যেতে পারছে না। সড়কে বাস কম থাকার কারণ জানতে চাইলে বসুমতি পরিবহনের পরিচালক খন্দকার মনির আহমেদ বলেন, বিভিন্ন পরিবহনের কর্মীদের সঙ্গে যাত্রীদের ‘ঝামেলা’ হওয়ায় চালকরা গাড়ি চালাতে চাইছেন না। গত রোববার মারামারির পর অনেক ড্রাইভার গতকাল সোমবার বের হয়নি। সকালেও কয়েকটা বাসে মারধরের ঘটনা ঘটছে। ভাড়া কম পাওয়ায় অনেকে গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে গাড়িতে নিয়ে আসার। যাত্রীদেরকেও বলছি, ভাড়ার চার্ট অনুযায়ী ভাড়া দেন। বেশিও দিয়েন না, কমও দিয়েন না।

বাস না পেয়ে গত রোববার রিকশায় চড়ে ফার্মগেইট থেকে মিরপুরের বাসায় ফেরেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা তাসনিয়া রহমান। গতকাল সোমবার সকালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বাস পেলেও তাকে অফিসে যেতে হয়েছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তাসনিয়া বলেন, যা ভিড়, এদিকে বাসও তেমন নেই। উপায় না দেখে দাঁড়িয়েই যেতে হচ্ছে। সিটিং সার্ভিস না থাকায় এখন গাদাগাদি করে যাত্রী তুলছে, গরমের মধ্যে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। পৌঁছতেও সময় লাগছে বেশি।

এভাবে তো নিয়মিত চলাফেরা করা সম্ভব না। রামপুরার একরামুন্নেছা স্কুলের শিক্ষক রাখী রায় বলেন, তার এলাকায় আগের সিটিং বাসগুলোতে লোকালের মত লোক তোলা হলেও সিটিং সার্ভিসের মতই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। মেরাদিয়া থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত লোকাল ভাড়া ৫ টাকা। আমার কাছ থেকে আজকেও ১০ টাকা নিল। সদরঘাট থেকে প্রগতি সরণি হয়ে গাজীপুর চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহনেও রোববারের তুলনায় ভাড়া কমানো হয়েছে।

কিন্তু গাড়ি কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রামপুরা উলনের বাসিন্দা মেরাজ উদ্দিন। বাসে তো ওঠার জো নাই। গাড়ি ঠাসাঠাসি করে তবেই ছাড়ে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে হেল্পার বলে সামনে নাইমা হাইট্টা যান। সাংবাদিক নাদিয়া সারওয়াত জানান, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করার পর নতুন ঝামেলা তৈরি হয়েছে। অনেক বাসে আর নারী আসন সংরক্ষণের নিয়ম মানা হচ্ছে না। পরিবহন শ্রমিক কিংবা যাত্রীদের বেশিরভাগই নতুন নিয়ম ঠিকমত জানে না। বাসের সংরক্ষিত আসন নিয়ে সবসময়ই ঝামেলা ছিল।

কিন্তু এখন হেল্পাররা বলছে, শুনলাম সিটিং সার্ভিস নাই, তাই মহিলা সিটও নাকি নাই। বাসে ভাড়ার তালিকা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে যাত্রীদের মধ্যে। অনেক যাত্রী বিআরটিএর ২০১৫ সালের করা তালিকা অনুযায়ী ভাড়া দিতে নারাজ। এ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরদের সঙ্গে তর্কে জড়াচ্ছেন তারা। নতুন বাজার থেকে মহাখালী যাওয়ার জন্য বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে ওঠা শাহ আলমের কাছে তালিকা অনুযায়ী ১৩ টাকা ভাড়া চাওয়া হলেও তিনি ১০ টাকার বেশি দিতে নারাজ। তিনি বলেন, এরা পুরনো তালিকা ধরে ভাড়া নিচ্ছে। পরে যে তালিকায় করছে, সেখানে তো ভাড়া কমাইছে। কিন্তু সে তালিকা তারা আনে না। বাসে ভাড়ার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন করলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান বলেন, ২০১৫ সালের পর আর নতুন করে তালিকা হয়নি। ভাড়ার তালিকা নিয়ে যাত্রীদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

সাম্প্রতিক