nrb-pস্টাফ রিপোর্টার: অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভ্যাট পরিশোধের পদ্ধতিও ঠিক করে দেয়া হলেও পেট্রোবাংলা তা আমলেই নিচ্ছে না। ফলে দিন দিন বাড়ছেই বকেয়া ভ্যাটের পরিমাণ। এ পরিস্থিতিতে বকেয়া আদায়ে হার্ডলাইনে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাট আদায়ে এনবিআর পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। বিগত ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পেট্রোবাংলার বকেয়ার পরিমাণ ২২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। ওই টাকা পরিশোধ করা হয়নি। তারপর ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আরো ৮ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ভ্যাট জমা হয়। সব মিলে বর্তমানে ভ্যাট বাবদ পেট্রোবাংলার বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। তার সধ্যে সুদ-আসল উভয় টাকাই আছে। অথচ পেট্রোবাংলা গ্রাহকের কাছ থেকে গ্যাস সরবরাহের বিপরীতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করলেও তা সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে না। পেট্রোবাংলা ও এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পেট্রোবাংলা লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আদায় করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আটকে রেখেছে। বহু তাগাদা দিয়েও ওই অর্থ আদায়ে ব্যর্থ এনবিআর। সর্বশেষ বিষয়টি অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে পেট্রোবাংলা এনবিআরের বকেয়া পরিশোধ না করে ওই টাকা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করে মোটা অংকের লাভ নিচ্ছে। সম্প্রতি পাওনা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধের তাগাদা দিয়ে পেট্রোবাংলায় আধা-সরকারিপত্র পাঠিয়েছে এনবিআর চেয়ারম্যান। এর অনুলিপি অর্থ সচিবকেও পাঠানো হয়েছে। সেখানে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পেট্রোবাংলার ভর্তুকির অর্থ এনবিআরের কোডে জমার ক্ষেত্রে সহায়তা চাওয়া হয়।

সূত্র জানায়, নিয়ম মাফিক ভ্যাট পরিশোধ না করায় ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে এনবিআরের ভ্যাট বকেয়া দাঁড়ায় ২২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ পাওনা ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা এবং সুদ বাবদ ৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। ওই অর্থ আদায়ে গ্যাস বিতরণকারী ৪টি কোম্পানির বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির মামলা করে ভ্যাটের বৃহৎ করদাতা ইউনিট। তারপর বিষয়টি অর্থমন্ত্রীকে জানানো হলে তিনি পাওনা আদায়ে জ্বালানি উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ২০১৫ সালের ৮ মার্চ ওই জটিলতা নিরসনে বিদ্যুৎ সচিবকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করা হয়। সর্বশেষ সুদ ব্যতীত ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধের ব্যাপারে দু’পক্ষ একমত পোষণ করে। ওই ব্যাপারে অর্থ বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। একই সাথে আইওসির (ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কর্পোরেশন) বিল পরিশোধের পর প্রতি মাসে যে অর্থ থাকবে তা দিয়ে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ওই সিদ্ধান্ত বান্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আরো ৮ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ভ্যাট জমা হয়। বিগত ৬ ডিসেম্বর ভ্যাটের অর্থ পরিশোধ করতে পেট্রোবাংলা থেকে অর্থ বিভাগের কাছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়। অর্থ বিভাগ থেকে ভর্তুকি না দিয়ে সুদযুক্ত ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু ওই ঋণের অর্থ দিয়ে ভ্যাট পরিশোধ করেনি পেট্রোবাংলা। ফলে সামগ্রিকভাবে পাওনা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত মাসে অর্থ সচিবের কাছে পাওনা পরিশোধে চিঠি পাঠায় এনবিআর চেয়ারম্যান। চিঠিতে অর্থমন্ত্রীর অনুশাসন মোতাবেক সুদ ছাড়া ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা জানুয়ারির মধ্যে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধের অনুরোধ জানানো হয়। তাছাড়া ৮ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকার মধ্যে পেট্রোবাংলার চাহিদা মোতাবেক ভর্তুতির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাও পরিশোধের অনুরোধ করা হয়।

এদিকে এনবিআর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলছেন, লোকসান দেখিয়ে পেট্রোবাংলা বহু বছর ধরে ভ্যাটের অর্থ পরিশোধ করছে না। বরঙ লোকসানের অজুহাতে সরকারের কাছ থেকে প্রতি বছরই মোটা অংকের ভর্তুকি নিচ্ছে। যেহেতু গ্রাহকদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হয়েছে ফলে পেট্রোবাংলাকে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। বারবার তাগাদা দেয়া হলেও ভ্যাট পরিশোধে গড়িমসি করছে পেট্রোবাংলা। সর্বশেষ সরকার গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির সুপারিশও বাস্তবায়ন না করায় প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার মতো ভ্যাট জমা পড়েছে। ওই অর্থ আদায় করতে না পারলে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা দেখা দেবে। তাই পাওয়া ভ্যাট আদায়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে এনবিআর। সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাব জব্দ করারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কারণ পেট্রোবাংলাকে আইওসির উৎপাদিত গ্যাসের বিপরীতে কোনো ভ্যাট বা সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে না। কিন্তু আইওসি থেকে কেনা গ্যাস সরবরাহের সময় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো পেট্রোবাংলাকে ওই রাজস্ব পরিশোধ করে থাকে। কিন্তু সংস্থাটি তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয় না। আর ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়া ভ্যাট আইনে গুরুতর অপরাধ।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলা বলছে, বেশি দামে গ্যাস কিনে তা ভর্তুকির মাধ্যমে সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিতে বিতরণ করায় তাদের পক্ষে ভ্যাট পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এনবিআর যেভাবে ভ্যাট দাবি করছে তা গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রক্রিয়ার সাথে মেলে না। পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) উৎপাদিত গ্যাস কিনে নেয়। পরে তা তিতাস, বাখরাবাদ, জালালাবাদ এবং কর্ণফুলী ওই চারটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মাধ্যমে গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। গ্যাস বিলের সাথে গ্রাহকদের কাছ থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়।

এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ জানান, এনবিআরের পাওনা টাকা পরিশোধের বিষয় নিয়ে দু’সংস্থার মধ্যে বৈঠকে সমঝোতা হয়েছে। এনবিআরকে কিছু টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আস্তে আস্তে বাকি টাকাও পরিশোধ করা হবে। পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) থেকে যে দামে গ্যাস কিনছে তার চেয়ে ঘনমিটার প্রতি ৩-৪ টাকা কমে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছে। তাতে কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাচ্ছে। আগে সরকার ওই টাকা ভর্তুকি হিসেবে দিতো। সম্প্রতি ভর্তুকিও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। সরকার যদি ভর্তুকি দিতো তবে এনবিআরের বকেয়া পরিশোধ সহজ হতো। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে পেট্রোবাংলার এফডিআর আছে। কিন্তু কোন ব্যাংকে কতো টাকার এফডিআর আছে তা কাগজপত্র না দেখে বলা যাচ্ছে না।

সাম্প্রতিক