স্টাফ রিপোর্টার ॥ রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। বাহান্নর মহান ভাষা আন্দোলন। রক্তে রাঙানোর ঐতিহাসিক দিনটি বাঙালি জাতি কোনো দিনই ভুলতে পারবে না, তা চোখ বুজেই বলে দেয়া যায়। স্মৃতিঘেরা এই দিনটির দিকে যদি আমরা পেছন ফিরে তাকাই তাহলে আমাদের চোখে ফুটে ওঠে প্রতিটি বছরের একুশে ফেব্রুয়ারির ভোররাতের চিত্র। শুধুমাত্র ঢাকা শহরের নয়, জেলা শহর নয়, উপজেলাগুলো এবং সেখান থেকে প্রতিটি ইউনিয়ন ও গ্রাম সর্বত্র একুশের প্রভাতফেরি নগ্নপদে অসংখ্য তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধÑবৃদ্ধা সবাই ছুটে চলে নিজ নিজ এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন জানাতে।
ইতিহাসের ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র মিছিলের ওপর বর্বর হামলা চালায় পুলিশ। আর পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা আরও অনেকে। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। পরপর আরও দু’দিন গুলি চলে মিছিলের ওপর। এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। স্বাধীন সত্তা আর স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয় বাঙালির মনে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের মোড় ঘুরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজ ভূখ-ে নিজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির এদিনের ত্যাগ আর গৌরবের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয় শহীদ দিবস, ভাষা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেয়ার দাবি ওঠে।
দাবি আদায়ের আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৫২ সালে এসে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আন্দোলন দমন করতে পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় ছাত্র সমাজসহ আন্দোলনরত ভাষা সংগ্রামীদের ওপর। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ঘনিয়ে আসে ২১ শে ফেব্রুয়ারি। সকাল ১০টায় মেডিকেল কলেজের আমতলায় সমবেত হয় শিক্ষার্থীরা। জরুরি আইন ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্ররা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে ছাত্ররা মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
মেডিকেল কলেজের সংস্কার কাজের জন্য স্তূুুুুুপ করা ছিল ইট। পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা এই ইট নিক্ষেপ করে তাদের ওপর। একপর্যায়ে পুলিশ বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করে ছাত্রদের ওপর।
১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসন শেষ হয়। পাকিস্তান নামে গঠিত হয় নতুন রাষ্ট্র। কিন্তু এতে বাঙালিদের কোনো সুবিধা হয় না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাহ্যিক স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু কাজকর্মে নয়।
একুশে ফ্রেব্রুয়ারিতে যে বর্বর হত্যাকা- সাধিত হয়েছিলো, তা স্বরণ করার জন্য প্রতি বছর ভাবগম্ভীর পরিবেশে শহীদ দিবস উদ্যাপন করা হয়। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল শহীদ দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
বাঙালির জীবনের সবখানে তা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাই বাঙালিতে স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্ধুদ্ধ করে। এরই মাধ্যমে বাঙালি আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের অধিকার আদায় করার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত হয়।
একুশের প্রেরণা থেকেই ১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী আন্দোলন হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাঙালির সংগ্রামী চেতনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। মাতৃভাষার মর্যাদা আদায় করতে গিয়ে বাঙালিদের মধ্যে একতা আসে। শোষণ থেকে মুক্ত হবার কথা তারা ভাবতে শেখে। বাঙালির জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জাতীয়তাবোধ বিশেষভাবে কার্যকর হয়েছিলো। তাই বলা চলে, একুশে ফেব্রুয়ারি সংগ্রামের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিই শুধু নয়, সমগ্র ফেব্রুয়ারি মাসকে এখন উৎসবের মাস হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আমাদের সংগ্রাম ও আন্দোলনগুলোর ইতিহাস যে একান্তই আমাদের সমগ্র জাতির ত্যাগ তিতিক্ষা, ঘাম ও রক্তদান এবং চরম গৌরবেরই ইতিহাস তা আমরা কি ভুলতে পারি?
< Prev | Next > |
---|