বেলাল হোসেন ঢালী
belal dhaliবাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ, পাশাপাশি সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল কিন্ত দুর্রভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারিনি। যুদ্ধকালে আমার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। যুদ্ধের স্মৃতি আমার তেমন মনে নেই। তবে সামান্য যেটুকু মনে আছে, তা আমাকে এখনো পীড়া দেয়। আমার বড় দুই বোনের পরে আমি। সবাই খুব আদর করে। বাবা চাকরি করেন জাহাজে। সারেং ছিলেন। গ্রামের সবাই বাবাকে আব্দুর রব সারেং বলে ডাকে। যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে কিন্তু বাবা বাড়ি ফিরছেন না। মা সারাক্ষণ পথের দিকে চেয়ে থাকেন। আমাদের ঢালীরহাটে (বরিশালস্থ মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার চানপুর ইউনিয়ন) তখন একটা মাত্র মুদিদোকান। সেই দোকানে এসে সব লোক ভিড় জমায়। রেডিও শোনার জন্য। সবাই বলাবলি করছে, “যুদ্ধ লাইগা গেছে। মেজর জিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করছে। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা ধইরা লইয়া গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।”

বঙ্গবন্ধু কিংবা মেজর জিয়া কে, তা কিছুই বুঝি না। বাড়ির বড়দের পেছন পেছন শুধু ঘুরি। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। কেমন জানি ভয় ভয় ভাব। মাঝে মাঝে গুলির ঠুসঠাস শব্দ। কিন্তু আমার ভেতরে ভয়ভীতি কিছুই কাজ করে না। কেন তা জানি না। হয়তো যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝার বয়স হয়নি তাই। আমার চাচা আব্দুল বাতেন। আমাদের মেহেন্দীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। হাতে সব সময় একটা ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন। অনেক সাহসী ও উদ্যমী তরুণ (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ডাক্তার)। বাতেন চাচার কথামতো আমাদের ঘরের পেছনে বড় একটা গর্ত করা হলো। সেই গর্তের ভেতর লুকিয়ে রাখা হলো ঘরের দামি সব জিনিস। চেয়ার-টেবিলগুলো ফেলে দেয়া হলো পুকুরের পানিতে।

একদিন মা আমাকে কোলে নিয়ে সামনের ঘরের দরজায় বসে আছেন। মায়ের অপেক্ষা বাবার জন্য। কিন্তু বাবা আসেন না। হঠাৎ আমাদের ঘরের পেছনের আলমারির কাচগুলো ঝরঝর করে ভেঙে পড়ল। শব্দ পেয়ে মা উঠে দাঁড়ালেন। আলমারির কাছে গিয়ে মা বললেন, “গুলি লাগছে।” কিন্তু ঘরের ভেতরে গুলিটা কীভাবে লাগল! মা বাড়ির সবাইকে ঢাকলেন। সবাই দেখে বলল, সামনের দরজা খোলা ছিল, সরাসরি ভেতরে গিয়ে লেগেছে। সবাই আরো বলল, আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমরা বসা ছিলাম।

একদিন হঠাৎ করে বাতেন চাচার ছোট ভাই সালাম চাচা আমাদের ঢালীরহাট থেকে দৌড়ে এসে বললেন, “মিলিটারি আইতেছে, সবাই ভাগো।” বাড়ির সবাই ছোটাছুটি শুরু করল। যে যা পারল, পোটলা-পুঁটলি বেঁধে রওনা দিল। মা বললেন, নানাবাড়িতে যাব আমরা। আমার নানাবাড়ির নাম পণ্ডিতবাড়ি। নানা ছিলেন এলাকার একমাত্র পণ্ডিত ব্যক্তি। এলাকার নামকরা বড় বাড়ি। বাড়িতে বড় ১০-১২টি ঘর। আমরা নানাবাড়ির কাছে না যেতেই দেখি, আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে সবাই বলছে, “পণ্ডিতবাড়ি জ্বালাইয়া দিছে।” মা একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। মায়ের এই অবস্থা দেখে এই প্রথম আমি কেঁদে ফেললাম। সবাই মাকে ধরে উঠিয়ে বলল, “এহন কান্দনের সময় নাই। তাড়াতাড়ি চলো।” মা বললেন, “আমি এহন আমার এই পোলাপান লইয়া কই যামু?” পরে মা আমাদের নিয়ে আমাদের দূর সম্পর্কের এক ফুফুর বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। পরদিন মা শুধু আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি দেখতে গেলেন। একটা ঘর ছাড়া সব ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পোড়া খুঁটিগুলো পুড়ে যাওয়া দেয়াশলাইয়ের অবশিষ্ট কাঠির মতো দাঁড়িয়ে আছে। যে ঘরটা পোড়েনি, সেই ঘরের মালিক মায়ের চাচাতো ভাই। তিনি রাজাকার ছিলেন। সবাই আর্তনাদ করে কান্না করছে আর রাজাকার মামাকে গালাগাল করছে।

কিছুদিন পর আমরা আমাদের বাড়িতে ফিরে আসি। যুদ্ধ শুরু হয়েছে দুই-তিন মাস হয়ে গেছে। এখনো আমার বাবার কোনো খোঁজ নেই। সবাই ধরে নিয়েছে, বাবা আর বেঁচে নেই। মা মনমরা হয়ে দরজায় সারাক্ষণ বসে থাকেন। একদিন নদীর পাড় থেকে একজন দৌড়ে এসে খবর দিল, আমার বাবা আসছেন। কিন্তু পায়ে তাঁর গুলি লেগেছে। আমি এবং আমার বড় বোন দৌড়ে গেলাম নদীর পাড়ে। গিয়ে দেখি, বাবার দুই হাতে দুটি ক্রাচ। সবাই ধরাধরি করে বাবাকে নৌকা থেকে নামাচ্ছে। বাবা বাড়িতে এসে বললেন, গুলি নয়, জাহাজের সিঁড়ি থেকে পড়ে তাঁর পা ভেঙে গেছে।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হলেও জলাবেষ্টিত আমাদের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাটি পাকিস্তানি হায়েনাদের দখলে থেকে যায়। ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার সেনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করলেও মেহেন্দীগঞ্জের পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেনি। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের কারণে এলাকাটি দখলে রাখতে সক্ষম হয় তারা।
অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর বাতেন চাচা এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের পরিকল্পিত আক্রমণের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় রাজাকার-আলবদর বাহিনী। মুক্ত হয় আমাদের মেহেন্দীগঞ্জ।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, নারী-পুরুষ তথা আপামর জনসাধারণ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।

যুদ্ধ শেষ হলে বাবার এক বন্ধু বাবাকে বললেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে, তোমার নাম লেখাও না কেন? সরকারি ভাতাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা পাইবা।” বাবা বললেন, “আমার তো দুর্ভাগ্য, পায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারলাম না।” বাবার বন্ধু বললেন, “যুদ্ধের সময় তোমার যে পা ভাঙছে, সেটা দেখাইয়া একটা সার্টিফিকেট নিয়ে রাখো, কাজে লাগবে।” বাবা বললেন, “আমার তো পা ভাঙছে আমার কর্মস্থলে। জাহাজে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে। আমি কেন...।” তিনি বললেন, “তোমার ভালোর লাইগাই বলছি, তা ছাড়া তোমাগো বাতেন তো মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার আছিল, তুমি...।” বাবা খুব রেগে গেলেন দেখে বাবার বন্ধু আর এ ব্যাপারে কথা বাড়ালেন না।

যুদ্ধের ভয়াবহতা তেমন না দেখলেও যুদ্ধপরবর্তী ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখেছি। ১৯৭২-৭৪ সালে মানুষ উপলব্ধি করেছে যে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কতটা কঠিন।

আজ মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করা হচ্ছে। বের হচ্ছে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম। নতুন তালিকা থেকে আসল মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের নাম নাকি বাদ দেবে আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করেন। আজ তাঁরই কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বীর উত্তম, স্বাধীনতার ঘোষক এবং পরবর্তী সময়ে তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করার সার্থক ও সফল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার পদক, স্বাধীনতার ঘোষণার দলিল সবকিছুই মুছে ফেলে নতুন করে ইতিহাস রচনা করতে চান! তাই তো আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর জনপ্রিয় শিল্পী হায়দার হোসেনের কন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে গাইতে ইচ্ছে করছে-
কী দেখার কথা কী দেখছি
কী শোনার কথা কী শুনছি...
৪৫ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুজছি...

সাম্প্রতিক