9639fbe9957fbdab0a2a7fe954935deb-PROF ANWAR-PASAরাইফেল, রোটি, আওরাত’ খ্যাত কথাশিল্পী, শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার ওপরে এই কলামটি লিখবো বলে কলম করেছি। আনোয়ার পাশা পশ্চিম বঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমাদের একজন ভাষা শহীদও পশ্চিম বঙ্গে জন্মগ্রহণকারী ছিলেন। পশ্চিম বঙ্গে অনেক খ্যাতিমান লোক বাংলাদেশে আর বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান লোক পশ্চিম বঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছেন।
আনোয়ার পাশার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত।’ এই উপন্যাসটি তিনি ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নরঘাতক আলবদর বাহিনীর হাতে ধরাপড়ার আগে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। এমন একটি মহৎ উপন্যাস লিখবেন বলেই কি তিনি ১৯৭১ সালে ঢাকা থেকে পড়তে পারেননি? যেমন শহীদুল্লাহ কায়সার ঢাকা থেকে নড়েননি ১৯৭১-র বাস্তব ঘটনার ওপরে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখবেন বলে। লিখেছেনও। নাম ‘কবে পোহাবে বিভাবরী।’ তাৎপর্যপূর্ন নাম। আনোয়ার পাশা ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসের শেষে বলেছেন, ‘পুরোনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কত দূরে। বেশি দূরে হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মাভৈঃ। কেটে যাবে।’
একটি নিদারুণ প্রেক্ষাপটে, ঘাড়ের ওপর দ-ায়মান পাকি ঘাতকের ধবংসলীলার অভিজ্ঞতা সামনে রেখে আনোয়ার পাশার নায়ক সুদীপ্ত শাহীন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, ‘মাভৈঃ কোট যাবে।’ সময়টা তখন তত্ত্বকথা আওড়ানোর সময় নয়। কখন যৌবনবতী মেয়েটার ঘাড় থেকে পাকহানাদারদের নামানো যাবে, সেই সময়। বাঙালি তখন যুদ্ধরত।
এই উপন্যাসে আনোয়ার পাশা ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই ছোট সময়ের সীমা পর্যন্ত রক্তাক্ত ঘটনা তুলে এনেছেন। না, শুধু ঘটনার বিবরণ দেননি, প্রতি মুহূর্তের ঘটনার সূত্র ধরে পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রের বিশ্লেষণ করেছেন। তাই উপন্যাসের আরম্ভে বলেছেন, ‘এই প্রথম রাত্রি তার কাটল বন্ধুর বাড়িতে। উনিশ শো একাত্তর খ্রিস্টাব্দের সাতশে মার্চের দিন গত রাত্রি পার হয়ে আটাশে মার্চের ভোরে এসে পৌঁছলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন। ঠিক এর আগের দুটো রাত? পঁচিশ ও ছাব্বিশ তারিখের দিন পেরিয়ে যে দুই রাতের সূচনা হয়েছিলো তাদের কথা সুদীপ্ত স্মরণ করলেন। সেকি মাত্র দু’টো রাত। দু’টো যুগ যেন। পাকিস্তানের দুই যুগের সারমর্ম। বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানীদের বিগত দুই যুগের মনোভাবের সংহত প্রকাশ মূর্তি। শাসন ও শোষণ। যে কোন প্রকারে বাংলাকে শাসনে রাখ, শোষণ কর। শোষণে অসুবিধা হলে? শাসন তীব্র কর। আরো তীব্র শাসন। আইনের শাসন যদি না চলে? চালাও রাইফেলের শাসন।’
এই হলো আব্বা হুজুরদের দেশ পাকিস্তান। মনে হয় আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি, আওরাত’ ইসলামি মুখোশের আড়ালের কদাকার চেহারাটা চিনতাম না।
সুদীপ্ত স্মরণ করলেন। সেকি মাত্র দু’টো রাত। দু’টো যুগ যেন। পাকিস্থানের দুই যুগের সারমর্ম। বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানীদের বিগত দুই যুগের মনোভাবের সংহত প্রকাশ মূর্তি। শাসন ও শোষণ। যে কোন প্রকারে বাংলাকে শাসনে রাখ, শোষণে অসুবিধা হলে? শাসন তীব্য কর। আরো তীব্র শাসন। আইনের শাসন যদি না চলে? চালাও রাইফেলের শাসন, কামান-মেশিন গানের শাসন।


এই উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহিন। এই নামটি পাকিস্তানি হর্তাকর্তাদের কাছে বড় বেখাপ্পা লেগেছিলো। আবার এই উপন্যাসের আরেক নারী চরিত্রের নাম ‘মিনাক্ষী নাজমা, তাও হিন্দু গান্ধী নাম। নাজমা না হয় চললো, কিন্তু মিনাক্ষী’?
সুদীপ্ত শাহিন এই উপন্যাসে তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালক করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পাক হানাদারদের পাশবিক, অমানবিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। আবার কথায় কথায় চলে গেছেন পাকিস্তানের ২৩ বছরের অন্ধকার ইতিহাসের ভেতরে। পাকিস্তান যে দস্তুর মতো একটি সাম্প্রদায়িক, মধ্যযুগীয়, সেনাতন্ত্রের রাষ্ট্র ছিলো, সেটা ঠিকমতো চিত্রিত করেছেন। পাকিস্তানপন্থী দালালদের চরিত্রও ফুটিয়ে তুলতে কার্পণ্য করেন নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল ভিসি ও শিক্ষকদের মুখোশও টেনে খুলে ফেলেছেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব বিদ্বান, মানবতাবাদী, প্রগতিশীল শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছিলো, তাদের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা এবং ড. গোবিন্দ্র চন্দ্র দেবের কথা আবেগময় ভাষায় তুলে ধরেছেন।
তুলনা করেছেন ড. ওসমান গনিকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে। ১৯৭১ সালে আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অল্প কথায় ওসমান গনি, মোনায়েম খানের যুগল চরিত্র অংকন করেছেন। বলেছেন, ‘ঐ একটা সমাবেশ ঘটেছিল বটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য মোনায়েম খান, আর উপাচার্য ওসমান গনি। আচার্য বললে মোনায়েম খান চটতেন।-
‘আমায় কি তোমরা হিন্দু ঠাওরাতেছ? মুসলমানের আচার্য হওয়া বড়ই দুষের কথা। কুটি কুটি টাকা খরচ কইরা শিক্ষা দিবার লাইগা এই যে বিল্ডিং বানাইয়া দিছি তা কি এমনি কাফের হওনের লাইগা? কেন, আমাকে তোমরা চ্যাঞ্চেলর কইতে পার না?’
তারপর আনোয়ার পাশা বলছেন, ‘মোনায়েম খানের অধীন অতি দৌর্দন্ড প্রতাপে ভাইস চ্যাঞ্চেলর গিরি করেছেন জনাব ওসমান গনি। কি যে ভয়ে ভয়ে তখন কেটেছে সুদীপ্তদের দিনগুলি। কবে কোন ছাত্র এসে তাদের পিটিয়ে দেয় সেই এক ভয়। তার উপর ভয় চাকুরির। কোনো কারনে অপছন্দ হলেই হ’ল, কোন দিক দিয়ে ফাঁক বের করে দয়া করে একটা চিঠি পৌঁছে দেবে তোমার বাড়িতে- অমুক দিন থেকে তোমার চাকুরির দরকার নেই। আর ওদের মধ্যে একজনতো ছিলেন পড়ে মূর্খ। বাংলা বিভাগের তৎকালিন অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাইকে রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনার ফরমায়েস দিয়েছিলেন। এবং আর একজন; কেবল নিজের উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য যিনি একজন মূর্খের তাবেদার হতে পারেন তাঁর নাম কি দেওয়া যেতে পারে? সে কি যেমন তেমন তাবেদারি? হুজুরের নির্দেশে ছাত্রদের ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে ছাত্রনামধারী গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে অধ্যাপককে পিটানো পর্যন্ত কোনাটাই বাদ যায় নি। অতঃপর আবু সাঈদ চৌধুরী যখন এলেন, ...ধোঁয়া ভর্তি বদ্ধ ঘরে দম আটকে মরতে মরতে সহসা যদি নির্মল নদীতীরে বাতাস মেলে তার হ'লে কেমন লাগে সেটা? ওসমান গনির পর আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন ঠিক তেমনি।’ অর্থাৎ পাতিস্তান, আইয়ুব খান, মোনায়েন খান আর ওসমান গনি একই অর্থবোধক। একজন সেনাতন্ত্রে, একজন ভাঁড়ামিতে, অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ে লাঠিয়াল গিরিতে পারদর্শিতা দেখিয়ে ছিলেন। এই তিনজনের আচরণে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের মর্তবা ফুটে উঠেছিলো, তার প্রাসঙ্গিক চিত্রায়ন করেছেন আনোয়ার পাশা।


যেহেতু ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ স্বাধীনতার উপন্যাস তাই ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলি এসেছে। এ উপন্যাস মূলত মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা ভিত্তিক, সংবেদনশীল হৃদয় থেকে উৎসারিত উপন্যাস। নিকট থেকে দেখার অনুপম চিত্র। তাই বলেছেন, ‘উপাচার্যের বাসার বিপরীত দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। কলাভবনের প্রাঙ্গণে সেই সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ। এই বটতলার এক বিশাল সভায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। গত ২রা মার্চ। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে উড়িয়েছিলো।’
ইতিহাসের অনিবার্য সূত্রেই এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও মাওলানা ভাসানীর কথা। বলেছেন ‘শুরু হয়েছে গত ৭ মার্চ থেকে। মুজিবুর রহমান গন-আন্দোলন শুরু করলেন। আমাদের ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতা? প্রশ্ন তুলেছিলেন সুদীপ্ত। বন্ধুর সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। কিন্তু আরতো তর্কের অবকাশ নেই। পাকিস্তান নামে কোনো দেশ পাঞ্জাব সিন্ধু অঞ্চলে থাকতে পারে। বাঙলায় নাই।’


অনেকবার এসেছে Ÿঙ্গবন্ধুর কথা। একবার এসেছে মাওলানা ভাসানীর কথা। মাওলানা বঙ্গবন্ধুর সমর্থন করেছিলেন, তার প্রসংশা করেছিলেন। একবারও আসেনি জিয়াউর রহমানের কথা। মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের ছবি জীবন্তভাবে এসেছে বাঙালিরা চলমান মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবেদনশীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। শিল্পগুণের কোনো বিচ্যুাতি ঘটেনি। ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ শুধু উপন্যাস নয় বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের সোনালী দলিল।

মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।

 

সাম্প্রতিক