একাত্তর টেলিভিশনে ঢোকার পরপরই বিপদে পড়লাম। পঞ্চাশজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ওপর স্টোরি করতে চাপ দিতে লাগলেন কর্মপাগল হেড অফ নিউজ শাকিল ভাই। সেইসূত্রেই আব্দুল্লাহ নামের এক কবুতর ব্যবসায়ীর ফোন নম্বর পেলাম। এখন আর নম্বরটি কে দিয়েছিলো মনে পড়ছে না।
২০১১ সালের অক্টোবরের কোনও এক সকালে হাজির হলাম মিরপুরের দারুস সালাম রোডের কবুতর ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ বাসায়। দোতলা না তিনতলা ঠিক মনে নেই। আন্ডার কনস্ট্রাকশনে থাকা একটা ফ্ল্যাট।
ঢুকতেই একটা ফাঁকা ড্রয়িং কাম ডাইনিঙের মতো। সেই ঘরের সামনে একটা ছোট স্টোর রুমের মতো রুম। মেঝে পাকা নয়। আর ডানপাশে দুইটা রুম। একটাতে দেশিয় সাধারণ জাতের কবুতর রাখা। আরেকটাতে ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম- আইপিএসও তৈরি করেন তিনি।
ডাইনিং রুমের বামপাশে বিরাট আকারের একটা কবুতর রাখার রুম। আব্দুল্লাহ আমাদের সম্ভাষণ জানালেন। নাস্তা করালেন দুধের তৈরি ফিরনি দিয়ে। পাক্কা মুসলমানের মতো- সাদা বড়ো পাঞ্জাবি, পায়জামা আর কাপড়ের গোলটুপি, দাড়ি। অমায়িক ব্যবহার।
নাস্তা শেষে আমরা স্টোরি করতে শুরু করলাম। জানলাম ১০ বছর ধরে মিরপুরের ওই রোডে বসবাস করছেন।
ছোটোবেলা থেকেই কবুতর ভালোবাসতেন। বিএ পাসের পর চাকরি না করে, শখের কবুতর পোষাকেই, পেশা বানিয়ে ফেলেছেন। ২০১১ সালে জানিয়েছিলেন, মাত্র বিশ হাজার টাকা দিয়ে একজোড়া কবুতর নিয়ে তিন বছর আগে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। আর তিনবছরে পটার, স্ট্রেজার, বুখারা, জ্যাকোবিন, ফ্রিলব্যাক, ফ্যানটেইলসহ নানা ধরণের সৌখিন কবুতর উৎপাদন করে নিজের মূলধনকে নিয়ে যান ১৯ থেকে বিশ লাখ টাকায়।
আমাকে দামী বা ফ্যান্সি কবুতর দেখাতে গিয়ে আব্দুল্লাহ তার খাঁচায় রাখা ১ লাখ বিশ হাজার টাকা জোড়া নেদারল্যান্ডের কবুতর দেখালেন। আমি মুগ্ধ হয়ে কবুতর দেখলাম। ভিডিও স্টোরি যাতে ভালো হয়, সে কারণে সেই কবুতর বের করে তাকে ওড়াতে বললাম। তিনি ওড়ালেন।
আমাকে সাক্ষাৎকার দিলেন- কীভাবে তিলে তিলে এ কবুতরের ব্যবসা করেছেন তা জানালেন। তখন তার মুখে ফুটে উঠেছিলো তৃপ্তির রেখা। আমরা আরেক ঘরে গেলাম যেখানে দেশিয় কবুতর রাখা।
আব্দুল্লাহ জানালেন, বিদেশি কবুতর ডিমগুলো পাড়ার পর দেশিয় কবুতর দিয়ে সেগুলোকে তা দেওয়া হয়। বিদেশি কবুতরগুলোর পাশাপাশি দেশিয় কবুতরের প্রতিও তার দারুণ মায়া দেখলাম। হাত দিয়ে আদর করলেন। একটাকে মনে হয় গালের সাথে চেপেও ধরেছিলেন।
জানালেন- তার কবুতরের ব্র্যান্ডের নাম নেই- আব্দুল্লাহর কবুতর বলেই সবাই চেনে। আমি বরাবরই প্রকৃতির অবলা জীব পোষেন এমন মানুষ দেখলে মুগ্ধ হই। তাদেরকে মনে হয় নির্মল মনের অধিকারী। আব্দুল্লাহকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
জেনেছিলাম তার মালিকানায় থাকা কবুতর রেস দেয়। শুনেছিলাম প্রতিদিন সকালে তার কবুতর আকাশে ওড়ে এবং এদেরকে ট্রেনিং দেন তিনি।
জানালেন, কবুতর থেকে খরচ বাদেই তার মাসিক আয় হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। একটা জিনিস দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আব্দুল্লাহ আমাদের শুটিং-এর মাঝখানেই হঠাৎ তার দামী কবুতরের ঘরগুলোতে পর্দা টানতে শুরু করলেন।
জিজ্ঞাসা করাতে বললেন- এর কারণ হচ্ছে কবুতর রাত হয়ে গেছে মনে করবে। নির্দিষ্ট সময় পর আবার পর্দা তুলে দিবেন। তখন আবার কবুতর মনে করবে সকাল হয়েছে। এভাবে দিনরাতের হিসেব গুলিয়ে ফেলে তারা বেশি বেশি ডিম দিবে। দিনে তিনবার এরকম করেন।
ফেরার সময় আইপিএস ব্যবসা নিয়ে প্রশ্ন করায়, একরকম তাড়াহুড়ো করেই তিনি বলেছিলেন নামাজের সময় হয়েছে। আমরা যেন তখনকার মতো কাজ শেষ করি।
২০১৭। কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে অনলাইনে খবরে দেখলাম- মিরপুরের দারুস সালাম রোডের জঙ্গি আস্তানায় বিস্ফোরণের। শুনলাম আত্মঘাতী জঙ্গির নাম আব্দুল্লাহ। মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধলো এই আব্দুল্লাহ কি সেই আব্দুল্লাহ!
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আব্দুল্লাহর ভিডিও রিপোর্টটি টিভিতে প্রচার হয়েছিলো। সেখানে নানাজনকে ফোন দিলাম সেই ভিডিও স্টোরিটি উদ্ধার করার জন্য। তারা আন্তরিকভাবে সাহায্য করার পরও স্টোরিটি উদ্ধার হয়নি।
কিন্তু আমার মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথাই, যিনি কবুতর ভালোবাসেন, তিনি শিশুসহ কীভাবে নিজেকে উড়িয়ে দেন-পুড়িয়ে দেন! আব্দুল্লাহ আপনার ভালোবাসার কবুতরগুলোকে কে দেখবে!
মানুষ ও জীবের প্রতি ভালোবাসার তীব্রতা কী তবে ধমান্ধতার কাছে পরাজিত হচ্ছে!
হাবিব ইমরান
লেখক: সাংবাদিক
Next > |
---|