স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’ তে আওয়ামী লীগের ‘রূপকল্প ২০২১’ এর ‘প্রতিচ্ছবি’ দেখতে পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার সংসদ অধিবেশনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি তাদের ভিশন ২০৩০-এ যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছে, তার অধিকাংশই বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে পূরণ করেছে। আগামি অর্থবছরে এর বাকি কাজগুলোও শেষ করা হবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গত ১০ মে সংবাদ সম্মেলন করে তার এই ‘ভিশন ২০৩০’ তুলে ধরেন। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী কী করতে চায়, তার বিবরণ সেখানে তিনি দিয়েছেন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের দেওয়া ‘রূপকল্প ২০২১’ এর প্রসঙ্গ তুলে ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলে আসেছেন, বিএনপি তাদের ‘অনুকরণ’ করছে। গত ২০ মে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় এ প্রসঙ্গে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমরা দিয়েছি বলেই তারা দিয়েছে। মানুষ তো মানুষকে দেখেই শেখে। সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী গতকাল বুধবার সংসদে বলেন, বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, রূপকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন উপযুক্ত কৌশল, যোগ্য নেতৃত্ব ও সুসংগঠিত দল। এর আগে নেতিবাচক রাজনীতি, অনিয়মতান্ত্রিক তৎপরতায় তারা ফিরে যাবেন না- এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির ‘ভিশন ২০৩০’ সম্পর্কে শেখ হাসিনার মূল্যায়ন- ক্ষমতায় গেলে কী কী করবে তার দীর্ঘ ফর্দ সেখানে দেওয়া হলেও কীভাবে কোন পদ্ধতিতে তার বাস্তবায়ন হবে, কীভাবে অর্থায়ন হবে তা স্পষ্ট নয়। এটি অনেকটা নির্বাচনী ইশতেহারের মত হয়ে গেছে। এই ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের আগে ক্ষমতায় যেতে হবে। তারা সংসদীয় পদ্ধতি ও গণভোট পদ্ধতিসহ আরও যেসব মৌলিক পরিবর্তন করার কথা বলছেন তার জন্য সংসদে দুই-তৃতীংশ ভোট লাগবে। কিন্তু এর আগে দুই দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা খালেদা জিয়ার দল আবারও সেই পর্যায়ে যেতে পারবে কি না- সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ প্রধান হাসিনা। বিএনপি তাদের শাসনামলে অনিয়ম-দুর্নীতি, জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতার যে দৃষ্টান্ত রেখেছে, এরপর ক্ষমতার বাইরে থেকে জ¦ালাও পোড়াওসহ অনিয়মতান্ত্রিক তৎপরতা দিয়ে যে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে, তা কাটিয়ে উঠে এতটা জনআস্থা অর্জন তাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিএনপির রাজনীতির সমালোচনায় তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, গ্রেনেড হামলা, সংসদ সদস্য হত্যাসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কাজে যারা পারদর্শী। তারা আবার জনগণকে কী আশার বাণী শোনাবে? বিএনপি তাদের শাসনামলে পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনাও গ্রহণ করেনি। তারা দুতিন বছরের পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল। আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এর কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সেই নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন এখন শেষ পর্যায়ে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে আমরা ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছি। রূপকল্পের বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আগামি দিনের বাংলাদেশকে বিশ্বে অগ্রগামী ও উন্নত জনপদে পরিণত করতে আমরা জাতিকে আমাদের এই মেয়াদের মধ্যেই রূপকল্প ২০৪১ উপহার দেব। আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত দেশের সমপর্যায়ে’ উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করার কথাও প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, সরকারের দৃষ্টি কেবল এক বছরে সীমাবদ্ধ নয়, আওয়ামী লীগ ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ পেরিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী ও উন্নত জনপদে পরিণত করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে সরকারের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত তিনটি সাইটের মধ্যে পরিবেশগত এবং অন্যান্য দিক দিয়ে সবচেয়ে সুবিধাজক ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় রামপালকে বেছে নেয়া হয়েছে। কিন্তু একটি মহল ‘ভিত্তিহীন, কাল্পনিক ও মনগড়া বক্তব্য’ দিয়ে সুন্দরবন ধ্বংস হবে বলে ‘মিডিয়ায় তথ্য প্রচার করে’ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। জাতীয় পার্টির এ কে এম মাঈদুল ইসলামের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এনজিও ব্যুরো নিবন্ধিত ২৫৩টি বিদেশি এনজিও কাজ করছে। ২০১৬ সালে জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি এনজিওগুলোকে তিন হাজার ৭৯৮ কোটি ৩৭ লাখ তিন হাজার ২৮৮ টাকা বিদেশ থেকে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে, পঁচাত্তরে বাবা-মাসহ স্বজনদের হারানোর পর দেশে ফিরতে না পারার জন্য জিয়াউর রহমানকে দাযী করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আমাদের (নিজে ও বোন শেখ রেহানা) বিদেশের মাটিতেই পড়ে থাকতে হয়। খুনি জিয়া আমাকে ও আমার বোন শেখ রেহানাকে দেশে আসতে দেয়নি। ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শাহজাহান কামালের এক প্রশ্নে একথা বলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। তখন দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের জন্য সেনা কর্মকর্তা জিয়াকে দায়ী করে আসছেন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। শেখ হাসিনা বলেন, খুনি মোশতাক ও তার দোসর জিয়াউর রহমান ১৫ অগাস্ট হত্যাকা- চালায়। এরপর হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পালা শুরু হয়। জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেয়। স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণার কারণে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই জার্মানিতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা; ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে গিয়েছিলেন বেড়াতে। শেখ হাসিনা বলেন, আমি ও রেহানা ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই রওনা হয়ে ৩১ জুলাই জার্মানি পৌঁছাই। ১৫ দিনের মাথায় হঠাৎ শুনি আমরা দুই বোন এতিম হয়ে গেছি, নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে গেছি। এরপর দুই বোন ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। পরে শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক এখন যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্য। ছয় বছর প্রবাসে থাকার পর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাবার দল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বলেন, আমি ও রেহানা দেশে ফিরতে চাইলে আমাদের বাধা দেওয়া হয়। রেহানার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তা জিয়াউর রহমানের নির্দেশে বর্ধিত করা হয়নি। ওই পাসপোর্টও ফেরত দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সময় জিয়ার রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকার বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপি নেতারা বাধা দেওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ আমাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করার পর আমি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসি। ওই সময় জিয়াউর রহমান আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। দেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মী বাহিনী সকল বাধা উপেক্ষা করে আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। দেশে ফেরার পরও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ার কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। দেশে ফিরে আমি যখন ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করতে যাই, আমাকে ওই বাড়িতে যেতে দেওয়া হয়নি। পিতা-মাতা, ভাইয়ের জন্য একটু দোয়া করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পুলিশ পাহারা ও গেটে তালা দিয়ে আমার পথ রুদ্ধ করা হয়। আমি রাস্তার উপর বসে পড়ি এবং আমাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া পড়ি। ১৯৮১ সালের ১২ জুন পর্যন্ত ওই বাড়িতে আওয়ামী লীগের কোনো মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।” শেখ হাসিনা ফেরার ১৩ দিন পর চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়া। তারপর ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ফেরত পান বলে জানান শেখ হাসিনা। িেজয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১২ জুন হঠাৎ করে ১ ঘণ্টার নোটিস বাড়িটি আমাকে তাড়াহুড়ো করে হস্তান্তর করা হয়।
< Prev | Next > |
---|