স্টাফ রিপোর্টার: শুধু ২৫ মার্চই নয়, মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস ধরে গণহত্যা হয়েছে। আর এ গণহত্যা কেবল ৩০ লাখে সীমাবদ্ধ নয়। এর চেয়ে বেশি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করা হয়েছে। গণহত্যা দিবসটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির জন্য দেশ-বিদেশে প্রতি বছরই পালন করতে হবে। গতকাল শনিবার গণহত্যা দিবসে জাতীয় প্রেসক্লাবের আলোচনা সভায় এ মত দেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনেরা।
২৫শে মার্চ গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। সভায় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, গণহত্যার দায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দায়। পৃথিবীতে অনেক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এত অল্প সময়ে এত বেশি মানুষ হত্যার ঘটনা ইতিহাসে নেই। এটি শুধু এখানেই হয়েছে। বড় রাষ্ট্রগুলো আমাদের পক্ষে ছিলো না উল্লেখ করে অধ্যাপক মামুন বলেন, আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব বাংলাদেশের পক্ষে ছিলো না। তাই কেউ এ গণহত্যার কথা বলে না। বললে এর দায় তাদের ওপরও বর্তাবে। এজন্য একটা সময় এটিকে মুছে দেওয়া হলো। মুক্তিযুদ্ধকে কেউ কেউ সিভিল ওয়ারও বলেন। যদি সিভিল ওয়ার হয়, তাহলে তো স্বাধীনতার বিষয়টি থাকে না। যদি গণহত্যা না হতো, তাহলে এত কম সময়ে এক কোটি লোকের চলে যাওয়া বা আবার ফিরে আসার ঘটনা ঘটতো না। ইতিহাসের এসব সত্য গোপন করা হয়েছে অভিযোগ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, কিন্তু হেজাবিদের (হেফাজত, জামায়াত, বিএনপি) কারণে দীর্ঘদিন এ বিষয়গুলো সামনে আসতে পারেনি। এখন পাঠ্যবইকেও হেজাবিকরণ করা হয়েছে।
কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছেন না, ৪/৫ জন ব্যক্তি ছাড়া। তিনি বলেন, গণহত্যার বিষয়টি সংসদে পাস হওয়ার পর সকল মহল অভিনন্দন জানিয়েছে। কেবল হেজাবিরা জানায়নি।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে এ ইতিহাসবিদ বলেন, শুধু ৩০ লাখ নয়, আরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের গবেষণা হচ্ছে। খুলনায় গণহত্যা জাদুঘর করা হয়েছে। গণহত্যায় নারীদের বিষয়টি আসেনি। সেগুলো যোগ করলে আরও বেশি হবে। তবে এ গণহত্যা কেবল ২৫ মার্চই নয়, পুরো নয়মাসই হয়েছে। তিনি বলেন, গণহত্যার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ছিলো। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে এর পরম্পরা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিমাসে মুক্তিযুদ্ধের একটি করে বিশেষ দিন পড়ে। যদি এ দিবসগুলো সবাই পালন করেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে না। যেমন ০১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করা যেতে পারে। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পৃথিবীতে গণহত্যার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। তবে কালোরাত একটিই। সেটি হচ্ছে ২৫ মার্চ। এ দিনটিকে জাতিসংঘ পালন করলো কি না করলো, আমরা পালন করে যাবো। তারা পালন না করলেও কিন্তু এটিকে মানতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে। আবেদ খান বলেন, ২৫ মার্চ রাতে আমি ইত্তেফাক অফিসে আটকে ছিলাম। যারা আটকে ছিলাম, তাদের মধ্যে এখন কেবল তিনজন বেঁচে আছি।
গণহত্যার পরে পুরো ঢাকা শহরে সাইকেল চালিয়ে গণহত্যা ও তা-বের দৃশ্য দেখেছি। এ গণহত্যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সামগ্রিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে নওগাঁয় গিয়েছিলাম। সেখানে ৩৫টি গণকবরের তথ্য পেয়েছি। এভাবে সারা দেশে গণহত্যা হয়েছে। আমার সাতক্ষীরা ও চুকনগরের কথাও বলবো। পুরো বাংলাদেশই গণকবরে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় রাজনীতির নামে এ গণহত্যাকে আড়াল করা হচ্ছে। রাজনীতিকে ধর্মীয় আবরণ থেকে বের করতে হবে। রাষ্ট্রের নীতিকে ধর্মীয় আবরণ থেকে মুক্ত করতে হবে। না হলে আমাদের শিক্ষা, আমাদের আন্দোলন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে। হারুন হাবীব বলেন, আমাদের সত্যকে ইতিহাসের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ইতিহাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সেজন্য গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির পুনর্জন্ম হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সোচ্চার হওয়ার সুযোগ এসেছে গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে। গণহত্যা শুধু একদিনে হয়নি, নয়মাস ধরে হয়েছে। ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীসহ যারা এসব গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলো, তাদেরও বিচারের পদক্ষেপ নিতে হবে। মতিউর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের মধ্যে চেতনা ধরে রাখতে সংবাদপত্রের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আর এগুলো ধরে রাখার জন্য সংবাদপত্রই ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধু ২৫ মার্চই নয়, নয়মাস ধরে গণহত্যা অব্যাহত ছিলো’। আগামীতে এ দিবস আরও বড় আকারে পালিত হবে। ভবিষ্যত বাংলাদেশের লড়াইয়ে এ দিবস পালনে সদা জাগ্রত থাকতে হবে। আমাদের আরও অনেক কিছু করার আছে। তবে শুধু আমাদের কথা লিখলে হবে না।
পাশাপাশি পাকিস্তানি যারা আমাদের পক্ষে তাদের কথাগুলোও আমাদের প্রকাশ করতে হবে’ বলেও মত দেন মতিউর রহমান। আমাদের এ গণহত্যা দিবস পালনে জাতিসংঘ স্বীকার করুক বা না করুক, আমাদের পালন করতে হবে’ বলে মন্তব্য করেন রাহাত খান। আলোচনায় আরও অংশ নেন সাংবাদিক এম শাহজাহান মিঞা, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক মোজাফফর হোসেন পল্টু, শাহীন রেজা নূর, আমিনুল ইসলাম, নাসিমুন আরা হক মিনু, কুদ্দুস আফ্রাদ ও মাইনুল আলম প্রমুখ। সভার সভাপতি শফিকুর রহমান জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে ১৩ সাংবাদিকসহ ২৫ জন শহীদের নামে ২৫টি গাছ রোপনের ঘোষণা দেন।
< Prev | Next > |
---|