স্টাফ রিপোর্টার: রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কথা বিবেচনায় না নিয়েই ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ সিরিজের দুটি উড়োজাহাজ লিজে আনা হয়। ওসব উড়োজাহাজ চলুক বা না চলুক প্রতিটির জন্য মাসে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ডলার (৪ কোটি ৭০ লাখ ১৬ হাজার টাকা) ভাড়া দিতে হবে। আর পাঁচ বছরের আগে চুক্তি বাতিলের সুযোগ রাখা হয়নি। চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উড়োজাহাজ দুটির সব ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বিমানকে বহন করতে হবে। তাছাড়া লিজের মেয়াদ শেষে উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নেয়ার সময় যে অবস্থায় ছিল তেমনভাবে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে একটি বিমান বসে গেছে। কিন্তু তারপরও বসিয়ে রেখেই এখন বিমানকে ওই উড়োজাহাজের ভাড়া গুনতে হচ্ছে। বিমান সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে ড্রাই লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজের একটি ২০১৪ সালের মার্চে আর অপরটি একই বছরের মে মাসে বিমানবহরে যুক্ত হয়। কিন্তু বিমানের বহরে যুক্ত হওয়া প্রথম উড়োজাহাজটি এক বছর ফ্লাইট চালানোর পরই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। ড্রাই লিজে আনা ওই বিমানের একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় বাকি ইঞ্জিনটিও নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আবারো আরেকটি ইঞ্জিন ভাড়ায় আনা হয়। আর গত ডিসেম্বরে ভাড়ায় আনা ওই ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকে বসে আছে উড়োজাহাজটি। কারণ নষ্ট ইঞ্জিন মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ সহজপ্রাপ্য নয়। ফলে ইঞ্জিন মেরামতের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সংস্থাটি। এখন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উড়োজাহাজটি ২৭ মাস বসিয়ে রাখতে হবে। অথচ লিজের শর্ত অনুযায়ী ভাড়া গুনতে হবে ঠিকই। মাসিক প্রায় ৫ কোটি টাকা হিসাবে যার পরিমাণ ১৩৫ কোটি টাকা। তাছাড়া ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ায় এর আগেও উড়োজাহাজটি টানা এক মাস বসিয়ে রাখার ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় যোগ করলে ভাড়ার পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪০ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বিকল উড়োজাহাজটি উড্ডয়নক্ষম করতে ইঞ্জিন মেরামত ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অর্থ সঙ্কটের কারণে ওই উড়োজাহাজের ইঞ্জিন দুটি মেরামতের কোনো পরিকল্পনা বিমান কর্তৃপক্ষের নেই। আবার লিজের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ২০১৯ সালের মার্চের আগে উড়োজাহাজটি ফেরত দেয়ারও সুযোগ নেই। ফলে উড়োজাহাজটি বসিয়ে রেখেই মাসে মাসে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান। যদিও আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে আনতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উড়োজাহাজটি ইজিপ্ট এয়ারের কাছে ফেরত দেয়ার চেষ্টা করছে বিমান কর্তৃপক্ষ। অথচ উড়োজাহাজ দুটি পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নেয়া হলেও বিশেষ কারণে চুক্তিতে তার আগেই জরিমানা ছাড়া ফেরত দেয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। আবার ফেরত দেয়ার সময় উড়োজাহাজ দুটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেও বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হবে বিমানকে। এমন পরিস্থিতিতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজ দুটি এখন বিমানের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সব জেনেও উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নিয়েছিল।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০০৭ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার আগ পর্যন্ত বিমানের লোকসান ছিল ১ হাজার ১৮২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আর পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর সংস্থাটি ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৫ কোটি ১৯ লাখ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৫ কোটি টাকা মুনাফা করে। তবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে আবারো লোকসান শুরু হয়। ওই অর্থবছরে ৮০ কোটি, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯১ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬০০ কোটি ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২১৪ কোটি টাকা লোকসান গুনে বিমান। তাছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিমানের লোকসান হয় ১৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে গত দুই অর্থবছরে লাভ করতে সমর্থ হয় বিমান। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩২৪ কোটি ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭৬ কোটি টাকা মুনাফা করে বিমান। বিমানের বর্তমান বহরে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর, চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ইআর ও দুটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ রয়েছে।
এদিকে ইজিপ্ট এয়ার থেকে উড়োজাহাজ লিজ আনার বিষয়ে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে কুর্মিটোলায় বলাকা ভবনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করেছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক অনুসন্ধান টিম। তখন তারা ইজিপ্ট এয়ার থেকে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজের লিজ সংক্রান্ত ফাইল দেখতে চান। ওই দুটি উড়োজাহাজ থেকে এখন পর্যন্ত কতো টাকা আয় হয়েছে এবং এর পেছনে কতো টাকা খরচ হয়েছে তারও তথ্য চান দুদক কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে লিজ নেয়া উড়োজাহাজ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএম মোসাদ্দিক আহমেদ জানান, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই উড়োজাহাজটি লিজ নেয়া হয়েছিল। কিন্তুইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার পর ঝামেলা দেখা দেয়। উড়োজাহাজটির দুটি ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার পর মেরামতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হলেও যন্ত্রাংশগুলো দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেও দুটি ইঞ্জিন ভাড়া নেয়া হয়েছিল। তবে সে ইঞ্জিনও যখন ঘন ঘন নষ্ট হতে শুরু করে। তখন কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজটিকে গ্রাউন্ডেড করার সিদ্ধান্ত নেয়। চুক্তি অনুযায়ী উড়োজাহাজটি ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিমানের কাছে রাখতে হচ্ছে। তবে তার আগেই উড়োজাহাজটি ফেরত দেয়া যায় কিনা দুই পক্ষের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
< Prev | Next > |
---|