26Marchস্টাফ রিপোর্টার॥ আজ মহান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কবি হাসান হাফিজুর রহমান যে ১৪ খন্ড স্বাধীনতার দলিল সংগ্রহ ও স¤পাদনা করেছেন, সেখানে লেখা আছে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব প্রস্তুতকৃত স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পরে ইপি আরের ওয়্যার লেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। সেই বাণী অবলম্বনে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা এম, এ, হান্নান বেলা ২ টার দিকে চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এর পর ২৭ মার্চ জনাব জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুর ঘাট বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সে ঘোষণায় জিয়া বঙ্গবন্ধুকে জাতির মহান নেতা বলেন। বলেন যে, বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেছেন এবং তার সরকারই বৈধ সরকার। 

জনগণই প্রথম স্বতস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতকা ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করে তখন বাংলাদেশের জনগণ ক্রুদ্ধ, সংগ্রামী আবেগে রাজপথে নেমে শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলেন। জনগণ জলস্রোতের মত হোটেল পূর্বানীর সামনে উপস্থিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শোনার জন্য। উপস্থিত উত্তাল জনগণকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা বিষয়টি দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রেরই ফসল।...............এ বেইনসাফীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবে, তার পরিণতি যা-ই হোক না কেনো। ষড়যন্ত্র যদি আরো চলে, তাহলে বাংলাদেশ নিজ প্রশ্নের মীমাংসা করে নেবে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে বলবো।’ (ড. মোহাম্মদ হাননান-বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস - পৃ: ২৫১-৫২)।

এ সময় স্বতস্ফূর্তভাবে জনগণ পলটন ময়দানে জমায়েত হতে থাকে। নেতৃত্ব দিচ্ছিলো ছাত্রলীগ। এই সমাবেশে উনসত্তরের গণঅভ্যত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘আর ৬ দফা, ১১ দফা নয়, এবার বাংলার মানুষের ১ দফা হচ্ছে, বাংলাদেশের সার্ব ভৌমত্ব।’ (ঐ- পৃ: ২৫২)। আরেকটি বক্তৃতায় অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বাঙালী গণতন্ত্র চেয়েছিলো, কিন্তু পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী তা দেয়নি। বাঙালীরা এবার তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করবে।’ (ঐ)।

এ কথা অনুধাবন করতে হবে যে, জাতীয় অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় নামে। তাদের চেতনার শাণিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। এ সময় তারা জিন্নাহর ছবি পুড়িয়েছে, আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভূট্টোর গলায় জুতার মালা পরিয়েছে। শ্লোগান দিয়েছে, ‘ভূট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ এ কথাও স্মরণে রাখতে হবে যে, জনগণের আবেগ ও আন্দোলন দমন করার জন্য বেলুচিস্থানের কসাই টিক্কাখানকে আনা হয়েছিলো। ২৬ মার্চ দুপুরে টিক্কা খান ঢাকা বেতারে ঘোষাণা দিয়েছিলেন, ‘৭০ ঘন্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে আমি মাটিতে পরিণত করবো, আমি মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ টিক্কাখানকে জনগণের আন্দোলনের ভয়ে বিচার পতি বি,এ, সিদ্দিকী শপথ পড়াননি, এটাও স্বাধীনতার একটি ধাপ।

স্বাধীনতার দাবিতে ক্রুদ্ধ শ্লোগান রত, উত্তাল জনগণের ওপর পাক সামরিক বাহিনী গুলিবর্ষণ করে বাঙালিদের হতাহত করতে থাকে ১ মার্চ থেকেই। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেন, ‘আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’ পয়লা মার্চেই বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন যা ২ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। সেখানে কৌশলে শব্দ চয়ন করে বলেন, ‘বাঙালিরা আর নির্যাতিত হতে চায় না। তারা একটি স্বাধীনদেশের স্বাধীন নাগরিক হতে চায়।’ এ আক্ষাঙ্খা তিনি ২৫ মার্চ পর্যন্ত বার বার ব্যক্ত করেছেন। এ সময় তিনি ছাত্রলীগকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে বলেন এবং তা গঠিত হয় ১ মার্চ বিকেল ৩ টায়। এই দিনের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগ নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। ‘এই সভায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতের কাঠামো ও রূপের বিশদ আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের সভায় ‘স্বাধীনতার প্রস্তাব’ পাঠ করা হবে।’ (ড. মোহাম্মদ হাননান- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- পৃ: ২৫৮)। এ দিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন ও উত্তোলন করা হয়।

৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের বিশাল এক জনসভা হয়। প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।’

এটাও এক ধরনের স্বাধীনতার ঘোষণা। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতার ইস্তোহার পাঠ করে বলেন, ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশে’।

সাম্প্রতিক