jkh8স্টাফ রিপোর্টার: বোরো চাষে নিরুৎসাহিত করছে সরকার। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বোরো চাষ। অথচ অন্যান্য মৌসুমে চাষ হওয়া ধানের চেয়ে বোরো মৌসুমে ধানের ফলন হয় বেশি। সেজন্য কৃষকরা এখনো বোরো চাষেই বেশি আগ্রহী। তাছাড়া হাওর, চরসহ দেশের বেশ কিছু এলাকার জমি একফসলি। বোরো মৌসুম ছাড়া অন্য কোনো মৌসুমে ওসব জমিতে ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। তবে বর্তমানে শ্রমিক সংকট, অধিক উৎপাদন খরচ, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়াসহ নানা কারণে দেশের অনেক জেলার কৃষকই ইদানিং বোরো ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও বোরো মৌসুমে ধান চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বোরো ধান থেকেই দেশের প্রধানতম খাদ্যের সবচেয়ে বেশি জোগান আসে। গতবছর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) দেশের ১১টি জেলার বোরো ধান চাষ নিয়ে জরিপ চালায়। ওই জরিপ প্রতিবেদনে বোরোর চাষ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, এবং ভবিষ্যতে তা খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলার আশঙ্কার কথা বলা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বোরো মৌসুমে গতবছর সারাদেশে স্থানীয় জাতসহ সব ধরনের ধানের আবাদ কম হয়। তাছাড়া ওই বছর বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রাই কম ধরা হয়েছিল। তবে চলতি বোরো মৌসুমে সারাদেশে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাত মিলিয়ে মোট ৪৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে গত ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬১ দশমিক ৩৩ শতাংশ সাফল্য হারে চাষাবাদ হয়েছে ৩০ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ হেক্টর জমিতে। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫-১৬ সালে বোরো ধান চাষ হয়েছিল ৪৬ লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে। আর ২০১৪-১৫ সালে বোরো চাষ হয়েছিল ৪৮ লাখ ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে। বিগত ২০১৪-১৫ সালে ৪৮ দশমিক ৪৬ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৯৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন চাল। এমন পরিস্থিতিতে বোরোর আবাদি জমি কমার হার রোধ করা না গেলে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ দেশে খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এদেশের প্রধান খাদ্যশস্যই হচ্ছে ধান। দেশের মোট চালের প্রায় ৫৬ শতাংশই উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। তবে জমির ভাড়া, শ্রমিকের মজুরি, সার, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় ১৯৯০ সালের পর থেকে ধানের উৎপাদন খরচ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। অথচ সে অনুপাতে কৃষকরা ধানের দাম পাচ্ছে না। ফলে দেশের বেশির ভাগ জেলার কৃষকরা বোরো ধান আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

সূত্র জানায়, কৃষকরা এখনো বোরো ধান চাষে বেশি আগ্রহী। কারণ অন্য ধানের চেয়ে এই ধানের ফলন তুলনামূলক ভালো হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে উৎপাদন খরচ। অন্য যে কোনো ধানের চেয়ে বোরো চাষাবাদে বেশি পানি ও সার-কীটনাশক লাগে। সেক্ষত্রে সেচের পেছনেই বেশি খরচ পড়ে। আবার কায়িক পরিশ্রমও বেশি লাগে। তারপরও বেশি ফলনের আশায় কৃষকরা অনেক জায়গাতেই বোরো চাষ বাড়াচ্ছে। তবে বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে বোরো চাষ নিরুৎসাহ করে তার পরিবর্তে ভুট্টা বা গমজাতীয় ফসল চাষে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বোরো চাষের উপযোগী অনেক এলাকায়ই ভুট্টার আবাদ ভালো না হওয়ায় কৃষকরা তাতে আগ্রহী হচ্ছে না। তাছাড়া বোরো উৎপাদন কমিয়ে ফেললে দেশে চালের ঘাটতি দেখা দেয়ারও আশঙ্কা করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। ওই বিশেষজ্ঞদের মতে, বোরো চাষে নিরুৎসাহ না করে বরং দেশের যেসব অঞ্চলে এমনিতেই অনেক চাষযোগ্য জমি অনাবাদি থেকে যায় সেগুলোতে ভুট্টা বা গমজাতীয় ফসল চাষে মানুষকে উৎসাহিত করা ভালো হবে। পাশাপাশি দেশের নদনদী, খালবিল নিয়মিত খনন করা হলে সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য ভূ-উপিভাগের পানিও সহজলভ্য হবে। তাছাড়া জমিতে পর্যায়ক্রমে পানি দেয়া এবং শুকানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় ৩০ শতাংশ পানি সাশ্রয় করাও সম্ভব। বিশেষ করে যেসব এলাকায় চুক্তিভিত্তিক সেচ খরচ নির্ধারণ করে ধান চাষ করা হয় সেখানে চাষির কোনো লাভ হয় না। সেক্ষত্রে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারলে সেচের খরচ কমে যাবে এবং বোরো চাষের প্রতি নেতিবাচক অবস্থান থেকে সরে আসা সম্ভব হবে। কারণ এখনো বোরো মৌসুমের প্রায় ৬৫ শতাংশ জমিতে ব্রি ২৮ এবং ব্রি ২৯ ধান আবাদ হচ্ছে। সেই সাথে প্রায় ১৩ শতাংশ জমিতে আবাদ হচ্ছে হাইব্রিড ধান। আর ব্রির জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ধান ২৯ সর্বোচ্চ হেক্টরপ্রতি ৫ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন ফলন দিচ্ছে। তার পরই রয়েছে ব্রি ধান ৫৮। যার গড় ফলন হেক্টরপ্রতি সাড়ে ৫ মেট্রিক টন। অন্যদিকে আমন মৌসুমে সর্বোচ্চ ফলন দেয় (ব্রি ৪৯) হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৭৯ মেট্রিক টন। অবশ্য আউশ মৌসুমে আমনের চেয়ে বেশি সর্বোচ্চ ফলন দেয় হেক্টরপ্রতি ৫ দশমিক ০২ মেট্রিক টন। আর কোনো কোনো হাইব্রিড ধানের গড় ফলনও হেক্টরপ্রতি ৫ দশমিক ৯৭ মেট্রিক টন ধরা হয়।

সূত্র আরো জানায়, সরকার ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যুৎচালিত সেচের ওপর ভর্তুকি দিয়ে থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ কৃষকই ওই ভর্তুকি সম্পর্কে অবগত নয়। ওই সুযোগে ভর্তুকির সুফল কৃষকের পরিবর্তে সেচযন্ত্রের মালিকরা ভোগ করে। সেক্ষেত্রে বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ওই ব্যবসা নিজেদের দখলে রাখে। কৃষকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও বোরো চাষে সমস্যা তৈরি হয় আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে। যেখানে বোরো চাষে হেক্টরপ্রতি ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ এক লাখ ১২ হাজার ৯৬০ টাকা, সেখানে আমনে খরচ ৮২ হাজার ৮৯ টাকা এবং আউশের খরচ মাত্র ৭৮ হাজার ২৪ টাকা করে। আর লাভ-ক্ষতির হিসাবে আমন থেকে হেক্টরপ্রতি ৬ হাজার ৮১১ টাকা নিট আয় হলেও আউশে লোকসান হয় হেক্টরপ্রতি ১২ হাজার ৩২৫ টাকা এবং বোরোতে লোকসান হয় সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ১১ টাকা।

এদিকে ধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোরো আবাদে লাগাম না টেনে সেচের পানি সহজলভ্য করা এবং আগাম বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষার লক্ষ্যে নদী-খাল-বিল খনন করা, সেচের খরচ কমানোর উদ্যোগ নেয়া, উৎপাদন মৌসুমের শুরু থেকে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ করলেই সবার জন্য ভালো হবে। তার বিপরীতে বোরো চাষের লাগাম টেনে ধরার মতো কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কৌশল দেশের প্রধানতম খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠার আশঙ্কা থাকে। কারণ এমনিতেই নানা সমস্যার কারণে কৃষকরা বোরোর প্রতি অনেক এলাকায়ই আগ্রহ হারাতে বাধ্য হচ্ছে। তার মধ্যে যদি সরকারের পক্ষ থেকে বোরোকে নিরুৎসাহিত করার মতো কোনো প্রক্রিয়া শুরু হয় তবে আগামী দুই-চার বছরের মাথায় দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। আর সেই সংকট বোরোর বিকল্প কোনো ফসল থেকে কাটানো যাবে না। কারণ বোরো মৌসুমেই দেশে চালের বড় জোগান আসে। তাই সরকারের উচিত বোরো ধান চাষের প্রতি কৃষকদের উৎসাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া। তাহলেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফসল উৎপাদন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. হানিফ মোহাম্মদ জানান, বোরো আবাদে খরচ বেশি। গরিব চাষিদের জন্য এখন বোরো চাষ করা কষ্টসাধ্য। কিন্তু নিত্যনতুন প্রযুক্তি আর সরকারের পক্ষ থেকে সার, কীটনাশক, বিদ্যুতে ভর্তুকি কাজে লাগাতে কৃষকদের মধ্যে সক্ষমতা অর্জনের আগ্রহ বাড়ছে। পাশাপাশি কৃষকরা সচেতনতা ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে কিভাবে খরচ কমানো যায় সেদিকেও বেশি নজর দিচ্ছে। তাই বোরো চাষ বাদ দিতে তারা খুব একটা আগ্রহী নয়। কারণ বোরো ধানের পর একই জমিতে অন্য ফসল ফলানো সহজ হয় কিন্তু বোরো বাদ দিয়ে অন্য ফসল ফলালে ওই জমিতে আবার অন্য ধান চাষ করা কঠিন। তাই কৃষকরা ধান থেকে সরতে চাইছে না।

এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজমুল ইসলাম সম্প্রতি কৃষি খাত ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে কৌশল নিয়ে এক পর্যালোচনা সভায় বলেন, আমরা এখন বোরো ধান চাষাবাদে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছি। কারণ এই ধান অনেক বেশি পানি খায়। সেচের জ্বালানি খরচ ও সার-কীটনাশকও বেশি লাগে। সব মিলিয়ে বোরোর উৎপাদন ব্যয় বেশি। ফলে কৃষকদের উৎপাদন খরচ ওঠাতে হিমশিম খেতে হয় । বরং তার তুলনায় ভুট্টা বা গমজাতীয় ফসলে লাভ বেশি। আর ভুট্টার প্রচলনও দেশে আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যা ভাতের তুলনায় অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। দেশে এখন উন্নত বিশ্বের মতোই বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত ভুট্টাসামগ্রীর খাদ্য পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক