স্টাফ রিপোর্টার: দেশের কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রই গ্রিড কোড মানছে না। চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে সঞ্চালন লাইনের ফ্রিকোয়েন্সি স্বাভাবিক নির্ধারিত সীমার উপরে চলে যাচ্ছে। আবার উৎপাদন চাহিদার চেয়ে কম হলে ফ্রিকোয়েন্সি নেমে যাচ্ছে নির্ধারিত সীমার নিচে। এমন পরিস্থিতিতে সঞ্চালন লাইনে বড় ধরনের বিপর্যয়, এমনকি ব্ল্যাক আউটের আশঙ্কাও থাকে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে গ্রিড কোড তথা ফ্রিকোয়েন্সি না মানার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে না জানিয়েই যখন তখন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তাতে বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে পড়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইনের কারণেও ঝড়-টর্নেডোর সময় গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনাও ঘটে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের আদর্শ ফ্রিকোয়েন্সি ৫০ হার্টজ। তার চেয়ে ১ দশমিক ২ হার্টজ কম বা বেশি হলেও তাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু ওই ফ্রিকোয়েন্সি যখন ৫১ দশমিক ২ হার্টজের উপরে উঠে যায় বা ৪৮ দশমিক ৮ হার্টজের নিচে নেমে যায় তখন জাতীয় গ্রিড তথা সঞ্চালন লাইনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। ফ্রিকোয়েন্সি কমে গেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন ব্লেড ও শ্যাফট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাতে মোটরের দক্ষতা কমে যায়। আর ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে গেলে জ্বালানি নষ্টের ঝুঁকি বাড়ে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় গ্রিড রক্ষা করার জন্য উৎপাদন কিংবা বিতরণ প্রান্তের যে কোনো একটি বন্ধ রাখা হয়। তাছাড়া বিদ্যমান সঞ্চালন লাইনের বড় একটি অংশও জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণেও ঝড়-টর্নেডোর সময় সঞ্চালন লাইনের ওপর গাছপালা ভেঙে পড়ে গ্রিড বিপর্যয় হচ্ছে।
সূত্র জানায়, অনেক বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি নিজেদের মিটার রক্ষা ও দুর্ঘটনা এড়াতে যখন তখন বিতরণ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাতে সঞ্চালন লাইন ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ সেবা। চলতি রমজানে ঝড় ও ঘূর্ণিঝড়ে ওসব ঝুঁকি আরো বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাতে পাওয়ার ট্রিপসহ প্ল্যাক আউটের আশঙ্কাও রয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়গুলোয় অনেক বিতরণ কোম্পানি একটু ঝড়-বাতাস শুরু হলে নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে না জানিয়েই উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে। আকস্মিক লোড কমে যাওয়ার কারণে গ্রিড চাপে পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে যে কোনো দিন গ্রিড বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়বে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিড ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর কথা বলা হলেও কাজ এগুচ্ছে না। বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণের সব পর্যায়ে সমন্বয় থাকা জরুরি। কিন্তু দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকেও সঠিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা উপলব্ধি করা হচ্ছে না। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আবারো বিপর্যয় ঘটতে পারে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর ভারত থেকে আমদানিকৃত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে জাতীয় গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি স্বাভাবিক সীমার নিচে চলে যায়। তাতে দুই দফায় দেশের জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডে স্মরণকালের বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। ওইদিন দুই দফায় সারা দেশ একযোগে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিগত২০০৯ সালে জাতীয় গ্রিডের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৩০৫ সার্কিট কিলোমিটার। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৮০৭ সার্কিট কিলোমিটারে। তার মধ্যে ৪০০ কেভির ২২১ কিলোমিটার, ২৩০ কেভির ৩ হাজার ১৮৫ কিলোমিটার ও ১৩২ কেভির ৬ হাজার ৪০১ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন রয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষা নেয়া হচ্ছে না। তাহলে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। কোনো কারণে গ্রিড বিপর্যয়ে পড়লেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রগুলো একে একে বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর সেক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা দূর করতে না পারলে সমস্যারও সমাধান হবে না।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম-আল-বেরুনী জানান, বিদ্যুৎসরবরাহ যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে সেজন্য প্রতি বছরই রুটিনমাফিক সঞ্চালন লাইন মেরামত করা হয়। কয়েক দিন আগেই চলতি বছরের মেরামত কাজ শেষ হয়েছে। তবে টর্নেডো ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো কারণে নির্দিষ্ট এলাকায় যখন কোনো লাইন আক্রান্ত হয় তখন তার প্রভাবটা অন্য এলাকায়ও পড়ে। পিজিসিবি সঞ্চালন লাইনে ফ্রি গভর্নর মোড অপারেশন (এফজিএমও) চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেটি চালু করা গেলে সমস্যা অনেকাংশেই কমে যাবে।
< Prev | Next > |
---|