মাহমুদুল বাসার
জল্পনা কল্পনার শেষে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ। ১৯৭১ সালের এই মাসের ১০ তারিখে আগরতলায় তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিলো। এই সরকার ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান করেছিলো। এটাকে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিলো। নাম দেয়া হয়েছিলো মুজিব নগর। এই সরকারের অধীনে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিলো। ভারত তার সমগ্র সহানুভূতি ও সহযোগিতা এই সরকারকে ভিত্তি করে প্রদান করেছিলো।
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসের ৭ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ জটিল হয়েছিলো। সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক জটিল করা হয়েছিলো। তখন দূর্ভাগ্য জনকভাবে পাকিস্তান প্রীতি বেড়ে গিয়েছিলো, ভারত বিদ্বেষ কাজে লাগানো হচ্ছিলো। খালেদ মোশারফের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা-বীরউত্তম এবং ‘কে-বাহিনী’র প্রধান, সেক্টর কমান্ডার ভারতের এজেন্ট অপবাদ নিয়ে জীবন বিসর্জন দিলেন। এরপর কর্নেল তাহেরও জীবন দিলেন ফাঁসির মঞ্চে কিন্তু তাঁকে ‘ভারতের দালাল’ বলা সম্ভব হয়নি। মাওলানা ভাসানীকে পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে ভারত বিরোধী রাজনীতি উত্তপ্ত করতে।
শত্রুকে মিত্র আর মিত্রকে শত্রু বানাবার রাজনীতি এ দেশে হয়েছে দীর্ঘ একুশ বছর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে অস্বীকার করা, উপহাস করা, অবজ্ঞা করার কথা ভুলে যাইনি আমরা। পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মেলালে ভারতকে অবজ্ঞা করতেই হবে। সে সময়টা আমরা পার হয়ে এসেছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারকে ‘ভারতের পুতুল সরকার’ বলার দিন শেষ হয়ে গেছে। তবে তিনি ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি করেছেন ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে। সেটা একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার। ওই চুক্তিরও ধারালো বিরোধিতা হয়েছিলো, উল্টো ব্যাখ্যা হয়েছিলো। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে ভারত বিরোধিতা একটি উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমান সময়ে তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। খুব সম্ভব মুখ ব্যাথা হয়ে গেছে। তাতে লাভের অংক বাড়েনি তাও উপলব্ধিতে এসেছে।
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাচ্ছেন ভারত সফরে। তাঁর সফরের সাফল্য তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। গায়ের জোরে আর চাপার জোরে কোনো দেশের সঙ্গে কোনো দেশের চুক্তি হয় না। চুক্তি হয় সমঝোতার ভিত্তিতে। শুধুমাত্র খাতিরের ভিত্তিতেও কোনো চুক্তি হয় না। চুক্তি হয় উভয় দেশের লাভ-লোকসান হিসেব করে। চুক্তিপত্র আবদারের দলিল নয়। দেশের স্বার্থ রক্ষার দলিল। প্রত্যেক দেশই প্রত্যেক দেশের স্বার্থ যাচাই করে দেখার পর যে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয়। কোনো দেশতো লোকসান দিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে না।
তাছাড়া ভারত আমাদের দেশের মতো একক সরকারের দেশ নয়, ওটা বহুমুখী সরকারের দেশ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ওপর খবরদারি করতে পারে না। রাজ্য সরকারের মতামতের গুরুত্ব দিতে হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের সমর্থন ছিলো মৌলিক ও ব্যাপক; ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ভূমিকা অতটা জোরালো ছিলো না। ১৯৯৭ সালের গঙ্গা চুক্তির ব্যাপারেও পশ্চিম বঙ্গের বামপন্থী সরকারের মৌলিক ভূমিকা ছিলো। কেন্দ্রীয় সরকারের সহানুভূতিতো ছিলোই। এখন তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসেছেন। তাতে আমরা তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জ্যোতিবসু নন, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় নন; তার রাজনীতি, তার ইগো সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। তিনি যথেষ্ট বেপরোয়া এবং তিনি কাটায় কাটায় হিসেব না মিলিয়ে তিস্তা চুক্তি করবেন না এবং তিস্তার পানি ছাড়বেন না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে ক্রিকেট খেলার সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। ভারত সফরে গিয়েই তিনি ছক্কা মরবেন, এমন চিন্তা করা অবাস্তব। শুধুই জেতার স্বপ্ন দেখা ঠিক নয়। চিন্তা করতে হবে প্রতিবেশি দুই দেশের স্বার্থ রক্ষার মাপকাঠিতে। এমন কোনো চুক্তি কিছুতেই হতে পারে না যে তাতে একদেশের লাভ অন্য দেশের লোকসান। এক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি আন্তরিকতায় ফাঁক রেখে আলোচনায় বসেন, তাহলে আমাদের জন্য সেটাই হবে লোকসান।
জাতীয় একটি পত্রিকায় দেখেছি তিস্তা চুক্তির চেয়ে গঙ্গাব্যারাজ চুক্তি হলে উভয় দেশ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে পানি লেনদেনে সুবিধাজনক। তিস্তার পানি ছাড়লে পশ্চিম বঙ্গের পানি প্রবাহে অসুবিধা হতে পারে, এমন বিশ্লেষণ এসেছে পত্রিকায়। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। তিস্তা চুক্তি না হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর ব্যর্থ বলে দমামা বেজে উঠবে। এই ব্যাপারটি সরকারের মাথায় না রেখে উপায় নেই। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়েও নানা ধরনের কথা চলছে। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু বিবেচনার মধ্য দিয়ে নিখুঁত পদক্ষেপ নেবেন, এ বিশ্বাস জাতি রাখে তাঁর ওপর। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবার পাত্রী তিনি নন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সুনাম ভারত উপমহাদেশের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পা দিয়ে মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। তিস্তা চুক্তি হয়তো কোনো কারণে বিলম্ব হতে পারে কিন্তু অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না শেখ হাসিনা, এ বিশ্বাস আমাদের অটুট।
মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।
< Prev | Next > |
---|