মোমিন মেহেদী
মানহীন পানি জারে ভরলেই বিশুদ্ধ! আশ্চর্য হই আমরাও যখন দেখি লেভেল লাগানো আছে নামি কোন কোম্পানীর কিন্তু তার মধ্যেই শ্যাওলা বা ময়লা ভাসছে। সারাদেশে তো অবশ্যই রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠা পানি সরবরাহ কোম্পানিগুলো বিশুদ্ধ নামে মানহীন পানি বাজারজাত করছে। কেউ ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে মেডিসিন ব্যবহার করে, কেউ অগভীর নলকূপের পানি সরাসরি জারে ভরে বাজারজাত করছে। প্রতিদিন পানিভর্তি হাজার হাজার জার বিভিন্ন অফিস, দোকান, রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক হোটেলে সরবরাহ করছে। এ পানি পান করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রকাশ্যে দুর্গন্ধযুক্ত ও মানহীন পানির রমরমা বাণিজ্য চললেও এসব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কার্যকর তৎপরতা নেই। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে একদিকে যেমন খেলে চলেছে ছাত্র শিবির-জামাত-জঙ্গী দেশবিরোধী চক্র; আরেকদিকে সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের সহযোগীতায় অন্ধকারের রাজনীতি-বাণিজ্য জমজমাটভাবে চালিয়ে যাচ্ছে স্বার্থন্বেষী মহল। এই দুই মহলেরই রয়েছে ছত্র ছায়ায় থাকা কালো মানুষের সারি। যে কারনে নির্মমতার অন্ধকারে রাত আর দিন এখন সমান প্রায়। যদিও আমাদের রাজনীতির রাঘব বোয়ালরা বলছেন যে, মানহীন পানিসহ খাদ্যসামগ্রী বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব অভিযানে মানহীন পানি উৎপাদন কারখানাকে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। শুধু মানহীন পানি নয়, খাদ্যের সামগ্রিক ভেজাল বন্ধ করতে ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব অভিযানের আওতায় মানহীন পানি পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু চরম সত্য হলো এই যে, ঢাকা ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় নগরবাসীর অনেকেই বাসাবাড়িতে জারের পানি কিনে খাচ্ছেন। এছাড়া রাস্তার ফুটপাতে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানগুলোয়ও এক গ্লাস পানি এক টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, স্কুল-কলেজ, বেকারি, ফাস্টফুডের দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চাহিদামতো জারের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। নামে-বেনামে মানহীন পানি জারে ভরে বিক্রি করছে ব্যবসায়ী নামধারী প্রতারক চক্র। নামসর্বস্ব কোম্পানিগুলো পানি শোধন না করেই বাজারজাত করছে। পানি প্রতারকরা ঢাকা ওয়াসার দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে জারে ভরছে। পরে বাজারজাত করছে। মাত্র কয়েকটি কোম্পানি মোটরের সাহায্যে পানি তুলে সরাসরি জারে ভরে বাজারজাত করছে। আমি যতদূর জানি বাংলাদেশ পিওর ড্রিংকিং ওয়াটার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, রাজধানীতে বৈধ পানি তৈরির কারখানা অর্ধশত। আর বাস্তবে পানির ব্যবসা পরিচালনা করছে ৩ শতাধিক কোম্পানি। বিএসটিআইয়ের তথ্যমতে, সারা দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পানি উৎপাদন কারখানার সংখ্যা ২৬০টি। এর মধ্যে রাজধানী এবং আশপাশের এলাকায় রয়েছে শতাধিক। ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, ৩৫টি পানি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের ওয়াসার পানি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। মোহাম্মদপুরের বছিলা, ঢাকা উদ্যান, চাঁদমিয়া হাউজিং এলাকায় ১০-১২টি জারপানি সরবরাহ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই কোনো অনুমোদন নেই। ওই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পানি উৎপাদন মেশিন, ল্যাবরেটরি, ক্যামিস্ট কিছুই নেই। বছিলা এলাকার একটি পানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা পানি সংগ্রহ করে অন্যত্র বিক্রি করেন। কথায় আছে, খালি কলসী বাজে বেশি। সেই কথার মত করেই বিএসটিআই এগিয়ে চলছে। দুর্নীতির সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করার মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি চোরকে বলে চুরি করতে গৃহস্থকে বলে সজাগ থাকতে। যে কারনে একের পর এক দুর্নীতিময় অবস্থানে নির্মিত হচ্ছে আমাদের খাদ্য স্তর। অবশ্য বিএসটিআইয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর নুরুল আমিন গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে বলেছেন, রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় জার পানি বিক্রির নামে অবৈধ পানির ব্যবসা চলছে। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা ও সিলগালা করে দেয়ার পরও তাদের থামানো যাচ্ছে না। কেননা এসব অবৈধ জারপানি কোম্পানিগুলো পরিচালিত হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতি ও সামাজিক কর্মী হিসেবে বিভিন্ন সময় যে দৃশ্য দেখেছি, তার আলোকে বলতে পারি যে, ঢাকা ওয়াসা রাজধানীবাসীর বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় জারপানির ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই পারে মানহীন জার বা বোতলের পানি-বাণিজ্য বন্ধ করতে। একই সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যেগে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও যেন নিবেদিত থাকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে, তাহলেই সম্ভব হবে বিশুদ্ধ পানিতে জীবন বাঁচাতে।
সারা ঢাকায় ওয়াসার পানির বদলে যখন বিভিন্নভাবে ভেজাল পানি বিক্রি হচ্ছে, তখন চোরের মার বড় গলার মত করে এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ। এ মান নিয়ে মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। তবে সরাসরি তো এসব পানি পান করা যাবে না। প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বাজারজাত করতে হবে বা খেতে হবে। এটা যারা করছেন, তারা অন্যায় করছেন। এটা দেখা আমাদের দায়িত্ব না।’ আমাদের দায়িত্ব এটা না, ওটা না তাহলে কোনটা আপনাদের দায়িত্ব? প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে। কেননা, নাগরিক হিসেবে সকল কিছুর দায়িত্বই আমাদের, আমাদের সবার।
সবচেয়ে কষ্টের একটি বিষয় নিয়ে বলবো এখন। আর তা হলো- এর মধ্যে ২১ মার্চ ছিলো বিশ্ব পানি দিবস। দেশের অর্ধেক মানুষ বিশুদ্ধ পানির সুবিধা বঞ্চিত হিসেবে তথ্য বেরিয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। কেন এই বঞ্চনা? কারণ পানিকে বিশুদ্ধ করার জন্য ১৩ মন্ত্রণালয় ও ৩৫ সংস্থার কাজ করার কথা রয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্য হলো যে, এদের মধ্যে কারো সাথেই কারো কোন সমন্বয় নেই। যে কারনে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমাদের ভোট ও ভাতের অধিকার অনিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ মানহীন পানি পান করে নানাবিধ রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ভয়ানক ঝুঁকিতে রয়েছে যশোর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, দেশের পার্বত্য ও হাওর এলাকার দুর্গম জনপদের মানুষ। যদিও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে আশ্বস্থ করতে বলেছেন যে, সরকার টার্গেটকৃত ২০২১ সালের আগেই দেশের শতভাগ মানুষ বিশুদ্ধ পানি সুবিধার আওতায় আসবে। সেই লক্ষ্যে বহুবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
কিন্তু তিনি হয়তো জানেন ই না যে, বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে দেশের ১৩টি মন্ত্রণালয়ের ৩৫টি সংস্থা। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানিসম্পদসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অধীন দফতর-অধিদফতর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিতের কাজ করছে। কিন্তু এদের কাজের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। যে যার মতো করে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি তুলছে।
অপরিকল্পিতভাবে পানি তোলায় এর স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির দূষণ রোধেও কার্যকর তেমন উদ্যোগ নেই। এক মন্ত্রণালয় দূষণ বন্ধের উদ্যোগ নিলে অন্য মন্ত্রণালয় কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। অনেক সময় তারা জানেই না পানির দূষণ রোধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একইভাবে আর্সেনিকসহ দূষিত পানির স্তর নির্ধারণে যথাযথভাবে কাজ হচ্ছে না। পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনাতেও সমস্যা দূর হচ্ছে না। দীর্ঘদিনের পুরনো লাইনে পানি সরবরাহ হচ্ছে। এসব লাইনে নানা ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটি সারানোর জোরালো উদ্যোগ নেয়া হয় না। এক মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত কাজ করতে চাইলে অন্য মন্ত্রণালয় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে থাকে। ফলে কাজ পিছিয়ে যায়।
অথচ সমন্বিতভাবে কাজগুলো সম্পন্ন হলে তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে এ খাতে সাফল্য অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উদাহরণ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। ভারতে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বাংলাদেশ চাইলে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সেই পথে এগোতে পারে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি গভীর ও অগভীর মিলিয়ে ১৫ লাখ ৩ হাজার ৩৭৯টি ওয়াটার পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ওয়াটার পয়েন্ট কার্যকর রয়েছে। আর ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৭৯টি ওয়াটার পয়েন্ট এখন বিশুদ্ধ পানির উৎস হিসেবে কাজ করছে না। এ হিসাব সংযুক্ত করলে বিশুদ্ধ পানির সুবিধাবঞ্চিতের হার আরও বাড়বে। যা আমাদের কারোই কাম্য নয়। আমরা চাই সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ। চাই সম্মৃদ্ধ-সুখি বাংলাদেশ।
যেখানে নিরাপদ পথ, নিরাপদ পানি, নিরাপদ খাবার, নিরাপদ জীবন, সর্বোপরি নিরাপত্তা থাকবে বিজয় বাংলাদেশ শ্লোগান দেয়ার জন্য-নিবেদিত থাকার জন্য। আর তাই সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সততা-সচেতনতা এবং আন্তরিকতা চাই; সোচ্চার হওয়া চাই-প্রতিবাদ চাই-প্রতিরোধ চাই সকল স্তরের দুর্নীতির-অন্যায়ের। তাহলেই শুধু পানি নয় সকল সমস্যা থেকে সমাধানের রাস্তায় অগ্রসর হবে বাংলাদেশ-বাংলাদেশের মানুষ...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
< Prev | Next > |
---|