মাহমুদুল বাসার
25marchদীর্ঘ বিলম্বের পর ২৫ মার্চ বর্তমান সরকারের আমলে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আরো আগে পাওয়া উচিত ছিলো। ড. মুনতাসীর মামুন দাবি করেছেন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি অনেক আগে থেকেই দাবি করে আসছে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে। কেন দিনটি গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা উচিত তার পক্ষে ড. মামুন জাতীয় পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিক কলাম লিখে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গত শনিবার ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে জাসদের সাধারণ সম্পাদক বেগম শিরিন আখতারের আনীত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।
সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রস্তাবটি সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানিদের গণহত্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পাকিস্তানি হানাদাররা যে গণহত্যা চালিয়েছে তার কোন প্রমান লাগে না। এই গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যতটা দায়ী, ততটাই দায়ী তাদের দোসর যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদর আল শামস্রা। (সমকাল-১২/০৩/২০১৭ইং)।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ২৫ মার্চ সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় আনুষ্ঠানিক ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে ...... তোফায়েল আহমেদ আরো বলেন, তবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশের নেতৃত্বে থাকায় দেরিতে হলেও গণহত্যা, দিবস ঘোষণা সম্ভব হয়েছে। (ভোরের কাগজ- ১৪/০৩/২০১৭ইং)।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালিয়েছিলো, তার সূচনা করেছিলো ২৫ মার্চের কালো রাতে। এই রাতের শেষ প্রহরে এবং ২৬ মার্চের সূচনা লগ্নে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাতেও পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণের উল্লেখ ছিলো। বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় যুদ্ধ চলছে’। (রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী-৭১ এর দশ মাস)।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের বুকের ওপর গণহত্যাযজ্ঞ চালবার প্রধান হুকুমদাতা ছিলেন ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টো। তাদের বক্তব্য ছিলো ‘বাংলার মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ ড. মুনতাসীর মামুন তার গবেষণায় তুলে ধরেছেন যে, ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ ছিলো ৩০ লাখের বেশি বাঙালি হত্যা করার। জেনারেল নিয়াজি স্বীকার করেছেন মাত্র ১৫ লাখের বেশি খতম করতে পারেননি।
আজকাল আমাদের দেশের বাঙালি-পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চের শুরু করা গণহত্যাকে হালকা করে দেখার চেষ্টা করছে। বেগম খালেদা জিয়া সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, ‘৩০ লাখ মানুষ হত্যা হয়েছে কিনা তা সন্দেহ।’ এটা কোনো মামুলি কথা নয়। এই অভিমত ব্যক্ত করে বেগম জিয়া পাকিস্তানি হত্যাকারীদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। তার পাকিস্তানি মেন্টালিটি কখনো গোপন থাকে নি। প্রটোকল ভঙ্গ করে তিনি ব্রিগেডিয়ার জানজুয়ার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। ড. মুনতাসীর মামুন দেখিয়েছেন, পাকি খান সেনাদের স্মৃতিচারণায় বিএনপির প্রশংসীয় স্থান।
শুধু ২৫ মার্চ রাতে যে নরমেধযজ্ঞ ঘটিয়েছিলো পাকসেনারা, তাকেই গণহত্যা বলা চলে। অথচ ২৫ মার্চের গণহত্যাকে আড়াল করার জন্য বিএনপি শাপলা চত্ত্বর থেকে হেফাজত হটানোকে বললো গণহত্যা। গণহত্যার প্রধান দোসর জামায়াতী নেতাদের তিনি বলেছেন ‘বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা’। আজকাল স্বার্থমগ্ন লোকজন ক্ষমতার স্বর্গ থেকে ভূতলে নিপতিত হয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে, ‘জয় পাকিস্তান বলেছিলেন।’ অথচ আমাদের জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সুবিখাত ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ উপন্যাসের ভূমিকায় বলেছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণ প্রসঙ্গেও একই ব্যাপার। জাস্টিস মুহম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেবের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের তারিখ’ প্রথম সংস্করণে তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষণের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, জয় বাংলা। জিয়ে পাকিস্তান, দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি ‘জিয়ে পাকিস্তান’ অংশটি বাদ দিলেন। কবি শামসুর রহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকন্ঠে ‘কালের ধূলোয় লেখা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিলো ‘জিয়ে পাকিস্তান’। আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের কথা শুনেছি। যারা আওয়ামী ভাবধায়ার মানুষ। সমস্যা হলো আমি নিজে ৮ এবং ৯ মার্চের সমস্ত পত্রিকা খুঁজে এরকম তথ্য পাইনি। তাহলে একটি ভুল ধারণা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?’
আবুল মনসুর আহমদও বলেছেন, আমি নিজকানে শেখ মুজিবকে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলতে শুনিনি। যা হোক, এই তর্কও এক সময় গবেষণার বিষয় হবে।
‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শব্দ গুলোর যে অর্থ দাঁড়ায় তাতে গণহত্যার কার্যক্রম বোঝায়। ১৯ মার্চ জয়দেব পুর বাঙালিরা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যে ভাবে লড়েছিলো, বুক পেতে দিয়েছিলো তাতে সূচনা হয়েছিলো গণহত্যার স্পষ্ট পদক্ষেপ। কথা শিল্পী সত্যেন সেন লিখেছেন ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ বইটি। পাকিস্তানি খান সেনাদের গণহত্যারই চিত্র এসেছে বইটিতে। প্রথম প্রবন্ধের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধে বীর প্রসবিনী চট্টলা’। সত্যেন সেন বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে একটা রহস্যজনক জাহাজ কড়া সামরিক পাহারায় জাহাজঘাটে এসে ভিড়েছে। সন্ধান নিয়ে জানা গেছে জাহাজে আরোহী নেই, সাধারণ মালপত্রও নেই। অনুমান করা যাচ্ছে, এই জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র, গোলা বারুদ আছে। যেগুলো এখানকার লোকদের ওপর প্রয়োগ করবার জন্যেই আমদানি করা হয়েছে।’
এটি ‘এমভি সোয়াত’ জাহাজ। এই অস্ত্র আনা হয়েছিলো গণহত্যা সংঘটিত করার জন্য। দৈনিক ভোরের কাগজে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার পদক প্রাপ্ত লেঃ কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক দেশের বিভিন্ন জনপদ ঘুরে নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে গণহত্যার নানা ঘটনা লিখে প্রকাশ করেছেন। তাতে গণহত্যার লোমহর্ষক চিত্র বের হয়ে আসছে।
আজ ২৫ মার্চ, একাত্তরের এ দিনে বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিলো জঘন্যতম নৃশংসতা। শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। গণহত্যার নীল নক্শা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পাকিস্তানি দানবরা মেতে ওঠে নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধনযজ্ঞে/.......... এ রাতেই সূচীত হয়েছিলো জঘন্যতম গণহত্যা। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নিমর্মভাবে হত্যা করেছিলো প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে। পঁচিশে মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া সেই নিধনযজ্ঞ চলেছে টানা ৯ মাস। ..........
পাক হানাদার বাহিনী জেনারেল ইয়া হিয়ার নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গণহত্যা করে। সন্ধ্যা পেরিয়ে নিঃশব্দে নেমে আসে অন্ধকার। রাত ১০ টা ৩৫ মিনিটে নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা এখানকার হোটেল সেরাটন ঘিরে ফেলে। রিসিপশনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন বাচ্চা ক্যাপ্টেন লিখে দিলো, বাইরে বেরুলেই গুলি। .......... মেশিনগানের গুলিতে কান পাতা দায়। .......... রাত সাড়ে ১১ টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং এরপর একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এর চারপাশ, ধানমন্ডি, পিলখানার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্ সদর দপ্তরসহ রাজধানীর সর্বত্র নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পাশাপাশি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও। আগুন ধরিয়ে দেয় গান পাউডার ছিটিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন এলাকায়। (সংবাদ- ২৫/০৩/২০১৬ইং)।
এই ভয়াবহ কর্মযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞ নাকি গণহত্যা নয় বলছেন পাকিস্তানি লোকজন। বাঙালি-পাকিস্তানিরাও তাই বলেছেন তথাকথিত এক পাকিস্তানি লেখক গাঁজাখুরি একটা বই লিখে নিজেদের সাফাই গেয়েছেন আর ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। ১৯৫ জন পাকিস্তানি জল্লাদদের বিচারের দাবি উঠেছে। বর্তমান সরকার বিলম্বিত একটা সময় পার হওয়ার পরও ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন থেকে বাংলাদেশে এই দিনটি পালিত হলে বিশ্ববাসী জানতে পারবে, পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞের অপকীর্তি।


মাহমুদুল বাসার প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক।

সাম্প্রতিক