মোমিন মেহেদী
গণপরিবহন চলাচল না করলেও ২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চট্টগ্রাম মহানগরীতে তিনটি ফ্লাইওভার খুলে দেয়া হয়েছে আগেই। প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটির নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এসব ফ্লাইওভার দিয়ে প্রাইভেট কার ও দূরপাল্লার ট্রাক-বাস ছাড়া গণপরিবহন বলতে কোনো যান চলাচল করতে দেয়া হয় না। প্রায় একই অবস্থা রাজধানীর অধিকাংশ ফ্লাইওভারগুলোর। পাশাপাশি সহ্য না করার মত যন্ত্রণাদায়ক যানজট তো রয়েছেই। নগর পরিকল্পনাবিদ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ সবাই যখন এসব ফ্লাইওভার নিয়ে সমালোচনায় মুখর, ঠিক তখনই প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পঞ্চম ফ্লাইওভার নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। একদিকে রাজধানী ঢাকায় অসহ্য যন্ত্রণার যানজট আর ফ্লাইওভার নাম যন্ত্রণা; অন্যদিকে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভারের প্রকল্প; সব মিলিয়ে অপরিকল্পিত নগরীর অপরিকল্পিত একের এক প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আম জনতার মধ্যে তৈরি হচ্ছে প্রতিবাদের রাজত্ব। তাদের বক্তব্য হলো- এত এত ফ্লাইওভারের পরও ঢাকা বা চট্টগ্রাম নগরীর যানজট আগের মতোই। তাহলে জনগণের কষ্টার্জিত করের বিপুল অর্থ ব্যয়ে নতুন ফ্লাইওভার কেন, কার স্বার্থে?
উত্তর জনতার কাছে আছে। তারা জানে যে, যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবিরের ষড়যন্ত্রের হাত ধরে ফ্লাইওভারের খেলায় প্রথম মাঠে নামে চারদলীয় জোট প্রধান খালেদা জিয়ার সরকার। আর দ্বিতীয়ধাপে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দুই নেত্রীর-ই এক স্থানে ভুল ছিলো। আর সেই ভুল হলো- পরিবহন নিয়ন্ত্রণ, রিক্সা নীতি, রাস্তা প্রশস্থকরণের রাস্তায় অগ্রসর না হয়ে কেবল ফ্লাইওভারের রাস্তায় অগ্রসর হয়ে তমা কনষ্ট্রাকশন, ওরিয়ন গ্রুপ, শাহ সিমেন্ট, বসুন্ধরা সিমেন্টসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজ দিয়ে আরো ফুলে- ফেপে কলাগাছে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। যার বদৌলতে জামাত-শিবির তথাকথিত বিএনপির রাজনীতিকরা একদিকে; অন্যদিকে নব্য আওয়ামী লীগার-তথাকথিত ছাত্র-যুবলীগাররা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হয়েছে। দুই সময়ে দুই নামধারীরা উপকৃত হলেও এই ফ্লাইওভারের কারনে সমাজ জীবনে কোন শান্তির রেখাপাত হয় নি। বরং আমজনতার রাজস্ব থেকে উত্তোলিত অর্থের অপচয় হয়েছে। আরো খোলাসা করে বললে বলা যায়, ‘অকার্যকর’ এসব ফ্লাইওভার নিয়ে সাধারণ মানুষ, মন্ত্রী-এমপি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের ক্ষোভ-অসন্তোষের মধ্যেই নতুন করে আবারো ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ আরেকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে যাচ্ছে চউক। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল)। বাণিজ্যের উপর বাণিজ্য, যন্ত্রণার উপর যন্ত্রণা, পার্সেন্টিসের উপর পার্সেন্টিস সমস্যায় আমাদের রাজনীতি এগিয়ে চলছে, এভাবে চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে বিপদের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। আর তাই এই ফ্লাইওভার ফ্লাইওভার খেলায় না মেতে তৈরি হতে হবে রাস্তাগুলোকে প্রশস্থ করণের সদিচ্ছা নিয়ে। তাতে যদি একোয়ারের অর্থ দিতে হয় দিয়েও রাস্তা প্রশস্থ করণে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি সকল বাহনে নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন নীতি-সততা ও মেধা-যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে করতে হবে। তা না করে এর আগে যেমন বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে কাটগড় পর্যন্ত দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য ডিপিপি প্রেরণ করা হলেও তা ফেরত পাঠানো হয় প্রি-একনেক সভা থেকে। গত বছর ডিসেম্বরে এটি ফেরত পাঠানোর পর নতুন করে ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতে থাকে, আর এভাবে একের পর এক ‘অকার্যকর’ ফ্লাইওভার তৈরির রাস্তায় অগ্রসর হতে থাকে, বড় প্রকল্পে বড় ধরনের ‘আর্থিক সুবিধা’-‘কমিশন বাণিজ্য’ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশ, তাহলে আর যাই হোক কোনভাবেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না মধ্যম আয়ের দেশের সিঁড়ির দিকে। অবশ্য সাহসের সাথে জাসদ থেকে বেরিয়ে এসে একাংশের নেতৃত্বে থাকা চট্টগ্রাম-৭ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনের সংসদ সদস্য মাঈনুদ্দিন খান বাদল নতুন প্রজন্মের এই প্রতিনিধির মত করে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘চট্টগ্রামে উন্নয়নের নামে এসব ফ্লাইওভার বাজে নজির স্থাপন করছে।’ বড় প্রকল্পে বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা নেয়া যায় বলেই হয়তো ফ্লাইওভারেই চউকের ঝোঁক। যেখানে দক্ষিণ চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষের যাতায়াতের জন্য কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কয়েকশ’ কোটি টাকা জোগাড় করা যায় না, সেখানে গুটিকয়েক যাত্রী ও যানবাহন চলাচলের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকা কোথা থেকে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। কিন্তু এসব ব্যাপারে তাকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথা বললেও নগর উন্নয়নের নামে যে হাজার হাজার কোটি টাকার ফ্লাইওভার হচ্ছে, তা জনগণ দূরে থাক চট্টগ্রামের একজন মন্ত্রী-এমপিও জানেন না। কেউই এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নন। তাই লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের আগে চট্টগ্রামের সব এমপি, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করা উচিত।
তাছাড়া মনে রাখতে হবে যে, শহরের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটির ওপর একাধিক ওভারব্রিজ রয়েছে। ভূগর্ভে বক্সকালভার্ট রয়েছে। কোথাও কোথাও দুই পাশে পাহাড় রয়েছে। এসব ধ্বংস করে, পাহাড় কেটে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করে লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের চিন্তা করাটাও অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। যেমন অযোক্তিক ছিলো- খিলগাঁও ফ্লাইওভার, মহাখালী ফ্লাইওভারসহ বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভারের প্রজেক্ট ফাইল যারা তৈরি করে, তারা নিজেরা এবং একটি বড় স্বার্থন্বেষী মহলের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হওয়ার রাস্তাই মূলত তৈরি করে। যা জাতির জনক কন্যা শেখ হাসিনা গভীরভাবে খেয়াল না করায় বুঝতে পারেন না, অথবা ব্যস্ততার কারনে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না। এই সুযোগে গড়ে ফেলা হয় অর্থনৈতিক এই বিশাল ফাঁদ। যে ফাঁদে পা দিয়ে আম জনতার হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
ফ্লাইওভারের পরিবর্তে চারলেন বিশিষ্ট সড়ক, প্রধান সড়কে সহজ লভ্য অটো রিকসা, মিনিবাস চালু, সড়ক সম্প্রসারণ করে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট উন্নত করে শহরের যানজট নিরসন করা যায়। এতে খরচ যেমন অর্ধেকে নেমে আসবে, তেমনি নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ঢাকা পড়বে না। নির্মল সবুজে জীবনে নেমে আসবে বিন¤্রতার সুখ। আর তার জন্য চাই কেবলই আন্তরিকতা। লোভি মন্ত্রী-এমপি বা সংসদীয় সদস্য নয়; আন্তরিকতার সাথে তৈরি হওয়া আলোকিত মানুষদের স্বমন্বয়ে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ সারাদেশকে সাজানো কেবলই ইচ্ছের ব্যাপার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক হোন, নিবেদিত হোন, চোখ কান খোলা রাখুন। শত্রুরা বিভিন্নভাবে আপনার কাজকে সমালোচনামূখর করে তুলতে তৎপর। আর তাই সাবধানে পা ফেলার কোন বিকল্প নাই। পা ফেলুন সাবধানে-সবখানে। তবে মনে রাখবেন ফ্লাইওভার কোন সমাধান নয়; সমাধান আছে- রাস্তা প্রশস্থ করণ, সম্ভব হলে চারলেনে উন্নত করণ, বেশি বেশি অটো রিক্সা ও মিনিবাস চালু ও ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি কঠোরতার সাথে তৈরি থাকুন-নিবেদিত থাকুন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়বেন বলে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
Next > |
---|