মাহমুদুল বাসার
ফুটপাতে ফুলের গল্প
quesশিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। এ কথা যতই পুরোনো মনে হোক শুনতে, এ কথার সত্যতা অনস্বীকার্য। অশিক্ষিত ব্যক্তি যদি পশুর সমান হয় তাহলে অশিক্ষিত বা আধা শিক্ষিত কিংবা ভুয়াশিক্ষিত জাতিও গাধার সমান। বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের বাঙালি জন-গোষ্ঠীকে গাধা বানাবার নানা চক্রান্ত চলছে; প্রশ্নপত্র ফাঁস তার মধ্যে অন্যতম। বর্তমান সরকারের আমলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটবে, তাও এমন একজন সৎ সজ্জন শিক্ষামন্ত্রীর আমলে, এটা ভাবতে পারিনি।

এক প্রবীণ শিক্ষক আমাকে বলেছেন, ‘প্লেইন জেন্টেল ম্যান ইজ নট এ্যাট অল জেন্টেলম্যান।’ আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে প্লেইন জেন্টেল ম্যান বলেই মনে করা হয়। তার পর্যবেক্ষণ তেমন যুৎসই মনে হচ্ছে না শিক্ষাবিভাগে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মতো শিক্ষা মন্ত্রনালয়ও কম স্পর্শকাতর নয়। জাতীয় শত্রু-মৌলবাদীরা শিক্ষা পরিকল্পনার ওপর কেমন প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে, তার নজির দেখতে পেলাম পাঠ্যপুস্তকে কৌশল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সিলেবাস ঢুকিয়ে দেবার দৃষ্টান্ত থেকে। এই ব্যর্থতা শিক্ষামন্ত্রীর। এই আমির কুমির-মৌলবাদীদের দেশে দুর্বল সততা কোনো কাজে আসবে না। ভীরুতাকে অভিশাপ দেই। ২৪ ঘন্টা কেবল মৌলবাদীদের ভয়ে পা গুনে চলা কোনো সক্রিয় সরকারের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাও শিক্ষামন্ত্রীর দুর্বল ব্যক্তিত্বের স্মারক চিহ্ন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীরা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের সঠিক তদন্ত করতে হবে। তদন্ত প্রমাণিত হলে পরীক্ষা গুলো পুনরায় নিতে হবে। একই সঙ্গে এই অসৎ প্রক্রিয়ায় উচ্চ থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত যারাই জড়িত থাক, তাদেরই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে এটা শিক্ষাঙ্গনে ভয়াবহ দুর্যোগ ডেকে আনবে। জাতির এই ক্ষতি কখনো কাটিয়ে ওঠা যাবে না।’

তারা আরো বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকা ও প্রচার মাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ গুলোও আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছি। উদ্বেগের বিষয় হলো সরকার পদক্ষেপ নিলেও প্রশ্নফাঁসের খবর থামছে না। চলমান এসএসসি পরীক্ষায়ও বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় এসেছে। এগুলোর বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো তা এখনো জানা যায়নি। তারা আরো বলেন, ‘পরীক্ষা কক্ষ পরিদর্শনে শৈথিল্য মূল্যায়নের বিষয়েও বেশ কয়েক বছর ধরে কথা হচ্ছে। আমরা অবশ্যই চাই শিক্ষার্থীরা কৃতকার্য হোক। কিন্তু পরীক্ষা গ্রহনে বা উত্তরপত্রে মূল্যায়নে শৈথিল্য দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কৃতকার্য করা হলে তাদের জীবনে সত্যিকারের কোনো সাফল্য আনতে পারবে না। (সমকাল-১০/০৩/০২০১৭)।

বিশিষ্টজনদের অনতিদীর্ঘ বিবৃতি দু ভাগে বিভক্ত। প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত এবং শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত। শেষের দিকের কথা গুলো, অর্থাৎ পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের কক্ষ পরিদর্শন ও উত্তর পত্র মূল্যায়নের সময় কোনো রাঘব বোয়াল , কোনো সিন্ডিকেট জড়িত থাকেনা। নিরেট শিক্ষকরা এখন দায়িত্ব পালন করেন। দায়টা তাদের। এখানে সরকারের খবরদারিও কাজ করে না। আমি ২৩/২৪ বছর কলেজে শিক্ষকতা করেছি, পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালন করেছি, পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছি। অনেক ঘাপলার কথা আমার জানা আছে। সরজমিনে অনেক দায়িত্ব হীনতা আমি রেখেছি। যে অভিজ্ঞতার কথা বারান্তরে বলবো। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটি সরকার ছাড়া কেউ রোধ করতে পারবে না। এখানে রাঘব বোয়াল ও সিন্ডিকেট জড়িত। কেননা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে টাকার খেলা জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রশ্ন ফাঁসের ক্রাইমটা ঘটে চলেছে। আগের সরকারের আমলেও প্রশ্ন বাণিজ্য হয়েছে। দেশে সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে যে মারাত্মক ক্রাইম হচ্ছে টাকার লোভে, তার মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস একটি। এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিদ্বনেরা বিবৃতিতে যা বলেছেন, তার সঙ্গে একমত পোষণ না করার কেউ আছে বলে মনে হয় না।

যখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় তখন আনন্দের জোয়ারে দেশ ভাসতে থাকে। পত্রিকার পাতা জুড়ে থাকে ‘ভি’ চিহ্ন। কিন্তু যখন কোনো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই স্টার প্রাপ্তরা ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে যান, তখন তাদের হয় বেহাল দশা। মেধা যাচাইয়ে তারা টিকতে পারেন না। লজ্জাজনক নাম্বার পান, এমন খবর পত্রিকায় এসেছে।
ফলাফলের সঙ্গে খাটি শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই, পরীক্ষায় কৃত্রিম উপায়ে বেশি বেশি নম্বর পেলেও প্রকৃত শিক্ষা হয়নি তাই ভর্তি পরীক্ষায় তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তারা।
এবার বিদ্বানদের বিবৃতির গুরুত্ব তুলে ধরবো। যদি শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই পেয়ে যায়, যদি পরীক্ষার হলে তারা নকল করার সুযোগ পায়, যদি পরীক্ষক সততার সঙ্গে, পরিশ্রম স্বীকার করে উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেন তাহলে ওই স্টার প্রাপ্তরা কোনো ভর্তি পরীক্ষায়, কোনো চাকরির ইন্টারভিউতে সুবিধা করতে পারবেন না। সারা জীবন মার খাবেন। ওই স্টার ধুলোয় লুন্ঠিত হবে।

এ কথা বলতে বিবেকদের তাড়নায়, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন সরকারের তত্ত্বাবধানে ছাপা হয়। এই প্রশ্ন ফাঁস হলে তার দায় সরকার এড়াতে পারে না। কোনো নির্দিষ্ট সরকারকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। সরকার একটি নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে ভাঙিয়ে খাবার দালাল চক্র বরাবর ছিলো, এখনো আছে। এদের না হটিয়ে দেশকে উড়াল সেতুর উপর দিয়ে এগিয়ে নিলে কী হবে? এই যে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খাদিজা আক্তার নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করলো ছাত্রলীগের এক নেতা, এতে সমাজের ভেতরের পচনশীল চেহারাটা দেখিয়ে দেয়। সরকার এবং বিচার বিভাগ ওই দুর্বৃত্তকে যর্থাথ শাস্তি দিয়েছেন। এ জন্য আমরা খুশি। ঠিক এমনই এক হৃদয়হীন দুর্বৃত্তগোষ্ঠী সরকারের চোখে ফাঁকি দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করে টাকা উর্পাজন করছে। এরকম দল বোধ, সিন্ডিকেট তৈরি করে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করছে। বদরুল একজন খাদিজাকে জখম করেছে, আর এই চক্র হাজার হাজার শিক্ষার্থিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এই চক্র ৩০ লক্ষ্য শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশের প্রজন্মকে শিক্ষিত মুর্খে পরিনত করছে। নকল চোখ যেমন চোখ নয়, নকল চুল যেমন চুল নয়, নকল ফল যেমন ফল নয়, তেমনি নকল শিক্ষাও শিক্ষা নয়।

প্রশ্ন ফাঁসের দালালেরা জাতির কত বড় শত্রু, সে ব্যাপারে কোনো সরকারই যর্থাথ সচেতন নয়। তারা কেবল রাজনৈতিক প্রতি পক্ষকেই হটানোর চর্চা করে। রাষ্ট্রের দুর্নীতি, ক্রাইম, অপরাধকে বড় করে দেখে না। তাই প্রশ্ন ফাঁস করে যারা কালো টাকার মালিক হচ্ছে তারা জাতির কত বড় সর্বনাশ করছে, সে ব্যাপারটা আমলে নেবার গরজ করছে না সরকার। না হলে প্রতি বছর প্রশ্ন ফাঁস হবে কেন? এই অপরাধকে শিশুর কিডনি বিক্রি ও নারী পাচার, মানব পাচার, শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর বলা চলে। এরা মৌলবাদী জঙ্গিদের চেয়ে কম ক্ষতিকর কোথায়?

সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন, আমার কি জাতিকে খাটিঁ শিক্ষিত করে তুলতে চাই? না বছর বছর ভুয়া স্টার প্লাস দেখে অপরিনামদর্শী আনন্দে অবগ্রহন করতে চাই? আমরা টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা চাই না, স্টার সর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থাবস্থা চাই?টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা চাইলে প্রশ্ন ফাঁসকারী দস্যুদের দমন করতে হবে। অন্যদিকে নকলমুক্ত পরীক্ষা নিতে হবে।
শিক্ষকরা যদি অসৎ হন, তাহলে আমাদের ভরসা কোথায়? ব্যতিক্রম বাদে তারা কিন্তু ঠিকঠাক মতো পরীক্ষার হলে ডিউটি করেন না। ঠিকঠাক মতো পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষণ করেন না। আন্দাজে পৃষ্ঠাা গুণে নাম্বার দিয়ে যান। এই ক্রাইম কীভাবে ঠেকানে যায় তা শিক্ষামন্ত্রীকে ভাবতে হবে।

সর্বোপরি শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে রাখতে হবে। নকল বিদ্যা আর মুখস্থ বিদ্যা এ্কই জিনিস। শিক্ষা অর্জন করতে হয়, আত্মস্থ করতে হয়। খাঁটি শিক্ষাই বেঁচে থাকার হাতিয়ার, নকল শ্ক্ষিা তা নয়।

মাহমুদুল বাসার গবেষক, লেখক

সাম্প্রতিক