স্টাফ রিপোর্টার: দেশে রফতানি আয়ের চেয়ে পণ্য আমদানি ব্যয় সবসময়ই বেশি। আমদানি যতটুকু বেশি, ততটুকু হলো বাণিজ্য ঘাটতি। সামগ্রিক আমদানি ব্যয় ৯.৫০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬.১৫ শতাংশ। ফলে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশের সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৮৮ কোটি ডলার। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সেই হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৭৩ কোটি ডলার।
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) বিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৩৩৪ কোটি ডলার, যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.১৫ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৭২২ কোটি ডলার, যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯.৫০ শতাংশ বেশি।
সেই হিসেবে ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৮৮ কোটি ডলার। সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১০৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সেই হিসেবে প্রথম পাঁচ মাসে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৩৭ কোটি ডলার। মূলত বিদেশে চিকিৎসা, ভ্রমণ ও উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত ব্যয় সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া বেশ কিছু কাল উদ্বৃত্ত থাকলেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৭২ কোটি ডলারের ঘাটতি পড়েছে। যেখানে গত অর্থবছরের এই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ১৩৩ কোটি ডলার। গত জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত সময়েও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে মাত্র চার কোটি ডলার ঘাটতি ছিল। তা ছাড়া চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৩৭০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষ করেছিল বাংলাদেশ। তার আগের বছরে এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ২৮৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি হিসাবে ঘাটতি তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্সে বড় পতন। পণ্যের পাশাপাশি সেবা বাণিজ্যেও বাংলাদেশের ঘাটতি বেড়েছে। সেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশকে যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেছে, সে তুলনায় পেয়েছে খুবই কম অর্থ। আলোচ্য সময়ে এখানে বাংলাদেশ ১৭০ কোটি ডলারের ঘাটতিতে রয়েছে। গত অর্থবছরে প্রথম ৬ মাসে এ খাতে ১৩৮ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিল। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৯২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ বেশি।
এ সময়ে রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৬৪১ কোটি ডলারের পণ্য, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। রফতানি যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে আমদানি বেড়েছে বেশি হারে। আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স কমেছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৭৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে ১৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। দীর্ঘদিন পর গত সেপ্টেম্বরে এসে চলতি হিসাবে ঘাটতি শুরু হয়। তবে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে তেমন উদ্বেগের কিছু নেই। তবে রেমিট্যান্স যেভাবে কমছে, তাতে দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। এ বিষয়ে গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে সরকারের কিছু উদ্যোগ দরকার, যাতে রেমিট্যান্সের পতন থামানো যায়। এদিকে, গত অর্থবছরে জ¦ালানি তেলের দাম তুলনামূলক কম ছিল। বর্তমানে দর বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানির পরিমাণও বেড়েছে।
আবার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও বেশ বেড়েছে যার একটি অংশ পদ্মা সেতুর নির্মাণকেন্দ্রিক। ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির কারণে আমদানি বাড়লে তা ভবিষ্যতের উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির জন্য ভালো। শুল্ক বিভাগের তৈরি আমদানি পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে ২৪ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পাশাপাশি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও বাড়ছে। আর পেট্রোলিয়াম আমদানি বেড়েছে ৩২ শতাংশ।
এদিকে, আর্থিক হিসাবে অনুকূলে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থা। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও শেয়ারবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার কারণে আর্থিক হিসাবে ২৭০ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই এসেছে ৮৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ডলার। শেয়ারাবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৭০ লাখ ডলার।
Next > |
---|