মীর আব্দুল আলীম
সব সম্ভবের দেশ নাকি বাংলাদেশ! হালে তাইতো দেখছি আমরা। এখানে পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন মেলে; রাস্তায় গেলে ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে মাথার উপরে পড়ে; শিশুরাও নিরাপদ নয়; হরহামেশাই নির্যাতন আর খুন হয়। শিক্ষাগুরুরা শিক্ষার্থীদের উপরই চড়াও হয়, বাবা খুন হয় ছেলের মাতে, ভাই ভাইয়ের হাতে; সড়কে মানুষ খুনের মড়গ লাগে। এমন অবস্থায় আকাশটা কেন ভেঙ্গে মাথায় পড়ে না; আর জমিনটা বা ক্যান দেবে যায় না এটাই এখন প্রশ্ন। প্রতিদিন দেশজুড়ে হাজারও এমন ঘটনার জন্ম দিচ্ছি আমরা। আর এসব নিয়েই আমরা আজকের এ লেখা।
এক :
ঐ যে বলছিলাম সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। এদেশে সব কিছুই বেশ সহজে মেলে। যেন মামার হাতের মোয়া! কোন পরীক্ষায় অংশ নেবেন? সমস্যা নেই। প্রশ্নপত্র চাইলে পেয়ে যাবেন পরীক্ষার আগেই। মোয়া যত সহজলভ্য; তার চেয়ে সহজ এখন পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়া। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত বোর্ড পরীক্ষায়ও অনেক শিক্ষার্থী আগেভাগেই প্রশ্ন হাতে পেয়েতো মহা খুশি। আগের দিনই ফেসবুকে কল্যাণে প্রশ্ন মিলল। এত কিছুর পরও এখনও শিক্ষামন্ত্রনালয় যাচাই আর বিবেচনায় রেখেছেন বিষয়টি । প্রযুক্তি আর ফেসবুক ব্যবহার করে সবাই আগে প্রশ্ন দেখলো; দেখলো না কেবল সংশ্লিষ্টরা। এ যেন কানার হাঁটবাজর!
আমাদের দেশে এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রোধ করা যাচ্ছে না। সংশি-ষ্টদের তাবদ হুঙ্কার, আশ্বাস, ভবিষ্যদ্বাণী সবটাই যেন অকার্যকর মনে হচ্ছে। সব কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবারও এসএসসি পরীক্ষায় গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গণিত পরীক্ষার বহু আগে ফেসবুকে দেয়া প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার হলে দেওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। বারাবরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। সরকার জঙ্গি দমন করতে পারছে, সরকার বিশ্ব ব্যাংকে উপেক্ষ করেই পদ্মা সেতুর মতো কঠি কাজ গুলো করতে সক্ষমতা দেখানেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ব্যর্থ হচ্ছে কেন? প্রশ্ন হলো সংশ্লিষ্টরা কি না দেখার ভান করছেন। সবাই জানে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। পরীক্ষার্থী, অভিভাবকরাও বলছেন, যে প্রশ্ন তারা অনলাইনে পেয়েছে তার সাথে পরীক্ষা নেয়া প্রশ্নে পুরোপুরি মিল আছে। সবাই দেখছেন, জানছেন কিন্তু তাঁরা(!) কেন দেখছেন না। এটা কি তাহলে কানার হাট বাজার নাকি? প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা স্পস্ট হলেও সংশ্লিষ্টরা এর দায় কেন নিচ্ছেন না? এমনটা চলতে থাকলে আমাদের শিক্ষ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, শিক্ষার মান বলে কিছু থাকবে না। প্রকৃত শিক্ষিত জাতি থেকে বঞ্চিত হবে দেশ। আর তা দেশের জন্য ভয়ানক একটা সংবাদ।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। আমাদের কালেও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তখন কেউ হঠাৎ প্রশ্নপত্র পেলেও অল্প সময়ে এক জায়গা হতে আরেক জায়গায় পাঠানো দুঃসাধ্য ছিল। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া সহজ হয়েছে। কথায় আছে, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। প্রশ্নপত্র বিতরনে ভিন্নতা আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে কৈশলি হতে হবে। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে পরীক্ষার দিন সকালবেলা প্রশ্নপত্র ছাপানো এবং বিতরণ করা যায়। গণিত প্রশ্ন ফাঁসের পর প্রশ্ন ফাঁস রোধে পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্র স্থানীয়ভাবে ছাপা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বিবৃতি দিয়েছেন। বছর তিনেক আগে আমি প্রশ্ন ফাঁস রোধে আমার লেখা কলামে শিক।সা মন্ত্রনালয়ের কাছে কয়েকটি সুপারিশ করেছিলাম। তখন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাও এজাতিয় সুপারিশ পেশ করেন। তা বাস্তবায়নে মন্ত্রনালয় উদ্যোগিও হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যায়। আলোচিত সৎ এবং সাহসি মেজিষ্ট্রেট রোকন-উ-দ্দৌলার মতো সরকারি আমলাদের এখানে কাজে লাগাতে হবে। যথা নিয়মে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্নপত্রের নমুনা কপি সংগ্রহ করা হবে। পরীক্ষার রাতে ঐসব সৎ আমলাদের সমন্নয়ে গঠিত একটি দল সংগৃহীত প্রশ্নপত্র থেকে বেছে বেছে নতুন প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করবেন। তথ্য প্রযুক্তিতে ভরপুর থাকবে ঐ কক্ষ। সেখান থেকে পরীক্ষার আধা ঘন্টা আগে কেন্দ্র গুলোতে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠাতে হবে। কেন্দ্রে আধা ঘন্টা আগে শিক্ষার্থীদেরও প্রবেশ করাতে হবে। এ সময়ে প্রিন্টারে প্রশ্ন প্রিন্ট করে পরীক্ষার হলে সর্বরাহ করতে হবে। তাতে সুফল মিলতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য একটি সেন্ট্রাল সার্ভার থাকিবে। পরীক্ষার আধা ঘন্ট আগে কেন্দ্রীয় সার্ভার হতে পরীক্ষাকেন্দ্রে থাকা ট্যাব বা কম্পিউটারে প্রশ্ন পৌঁছে দিতে হবে। অথবা ই-মেইলেও এ কাজটি করা যায়। এক ক্লিকেই কয়েক শ’ ই-মেইল পাঠানো সম্ভব। দেশের সবচাইতে বড় পাবলিক পরীক্ষা হইল পিএসসি, যাহার কেন্দ্রের সংখ্যা কমবেশি ৬০০। এই পরীক্ষার জন্য প্রযুক্তিগত কাঠামো ১২-১৫ কোটি টাকার মধ্যেই গড়া সম্ভব এবং শুধু পিএসসি কেন, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিসহ যে কোনো কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা খুব সহজেই নেওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বর্তমান প্রশ্নপত্র ছাপা এবং পাঠানোর খরচও অনেক বেশি পরে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠালে বর্তমানের তুলনায় খরচ কয়েকগুণ কম হবে তাতে সন্দেহ নাই।
দুই :
এবার একটু শিক্ষা গুরুদের প্রসংঙ্গে আসা যাক। অতিত নিকটে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) নাট্যকলা বিভাগের চেয়্যারম্যান নিজ বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেছেন। লাঞ্ছিত ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পত্রিকান্তে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের চেয়্যারমান ড. আব্দুল হালিম প্রামানিক (সম্রাট) এক বিকেলে নাট্যকলা বিভাগের এক ছাত্রীকে তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে ক্লাসের জন্য বিভাগে আসতে বলেন। ছাত্রীটি সন্ধ্যার দিকে বিভাগে আসলে বিভাগীয় চেয়্যারম্যান সম্রাট তাকে বিভিন্ন একাডেমিক পরামর্শ দিয়ে বিভাগের শ্রেণিকক্ষে বসতে বলেন। শ্রেণিকক্ষে সম্রাট ছাত্রীর শরীর স্পর্শ করে তাকে কু-প্রস্তাব দেন। এ সময় ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী তাকে ধাক্কা মেরে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন।
যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন! এ যেন থামছে না। যৌন নির্যাতন করছে কলেজশিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারী, পুলিশ। ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রী, শিশু, তরুণী,আয়া, বুয়া, গৃহবধূ। রাস্তা-ঘাটে, চলন্ত বাসে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই পৈশাচিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান-কাল-পাত্রের ভেদ। যারা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপরতলার মানুষ, এ জাতীয় বিপদ তাদের ছুঁতে পারে কম। এ দেশে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশি। যারা নিম্নবর্ণের বাসিন্দা, তারা সম্ভবত এখনো ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করেন। ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন, আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। অন্যায় করে অপরাধীরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে।
তিন :
আমরা কেন কোথাও নিরাপদ নই? ঘরেও না; বাইরেও না। নিজ ঘরে থাকবেন? খুন হবেন। রাস্তায় যাবেন? গুম হবেন; যেকোনো সময় হুড়মুড় করে আপনার ওপরই ভেঙে পড়তে পারে ফ্লাইওভারের গার্ড কিংবা যান্ত্রিক দানব (পরিবহন) চাপা দিয়ে কেড়ে নিতে পারে আপনার প্রাণ। কর্মস্থলে থাকবেন? সর্বনাশা আগুনে যে অঙ্গার হবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায় এদেশে? নদীতে যাবেন? সেখানেও লঞ্চ ডুবিতে প্রাণ যাবে। কোনো নিরাপত্তা নেই, কোনো গ্যারান্টি নেই জীবনের। যখন যেখানে সেখানেই মৃত্যু। ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ছে, ব্রিজ ভেঙে পড়ছে, বিল্ডিং ভেঙে পড়ছে। যা কিছু মানুষের সৃষ্টি, সবই ভেঙে পড়ে মানুষের ওপর। ভাগ্যিস আকাশটা সৃষ্টিকর্তার গড়াছিল! তা না হলে সেটাও যে ভেঙে পড়ত ঘাড়ে। আজ স্বাভাবিক মৃত্যুই যেন অস্বাভাবিক। কিন্তু কেন? কে দেবে এর উত্তর? রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের (ফ্লাইওভার) গার্ডার ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। মালিবাগ রেলগেট ব্যস্ততম এলাকা। এখানে সারাক্ষনই যানজট লেগে থোকে। দিনের বেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটলে কি হতো তা সহজেই বোধগম্য। প্রতিনিয়ত একেরপর এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রানহানীর ঘটনা, গুম হওয়া, খুন হওয়ার ভয় আমাদের অশান্ত করে তুলেছে। নানা কারনেই এখন স্বজনদেও লাশের অপেক্ষায় থাকতে হয়। বারবার এমন হচ্ছে কেন?
চার :
দেশে শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা চলছেই। গড়ে প্রতিদিন একটি শিশু খুন হয় বলে অতিত নিকটে পত্রিকার খবওে জেনেছি। এ বছরের প্রথম দেড় মাসে (১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) সারা দেশে বিভিন্নভাবে ৪৫ শিশু খুন হয়েছে। গত বছরের প্রথম দুই মাসে শিশু হত্যার সংখ্যা ছিল ৪৮। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। কি বলব বলুন? আমরা শিশুদের প্রতিও চরম নির্দয়। আমরা অসভ্যতার সব সীমা ছাড়িয়েছি। শিশুর প্রতি সহিংসতার খবর প্রতিনিয়তই নাড়া দিচ্ছে মানব বিবেককে। বর্তমান সময়ে শিশুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত, সহিংসতার শিকার হচ্ছে। যেমন- ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হত্যা, নিখোঁজের পর মৃতদেহ উদ্ধার,শিশু পাচার, নবজাতক চুরি,গৃহ শ্রমিকের উপর নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাসের শিকার, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সমপ্রতি কালের একটি ঘটনার বর্ননায় যাওয়া যাক। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার নামোশংকরবাটী ফতেপুর মহল¬ায় স্বর্ণের চেইন ও কানের দুল আত্মসাতের জন্য দুই শিশু হত্যা করা হয়েছে। মেঘলা ও মালিহা নামের এই দুই শিশুকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে এ ঘটনায় গ্রেফতার বাড়ির মালিক ইয়াসিন আলীর ছেলের বউ লাকি আক্তার। এভাবে প্রতি নিয়তই শিশু নির্যাতন আর হত্যার ঘটনা ঘটছে।এতো শিশু নির্যাতন, এতো শিশু হত্যার পর বিরক্ত হয়ে ‘দুরুজাইগ্গা’ না বলে কি পারি?
পাঁচ :
সড়কে প্রতিদিন হরেদরে মানুষ মরছে। এর প্রতিকার নেই। দায়সারা আইন হলেও প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ করতে গেলে ধর্মঘট আন্দোলন হয়। আর এ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রীর বাসায়। আজ (যেদিন লিখছি ১ মার্চ) দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোণামতো এমনই- ‘মন্ত্রীর বাসায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত!’ এইতো সাধের বাংলাদেশ! বাহ্! কি দেশে বাস করি যে দেশের মন্ত্রীর বাসায় সিদ্ধান্ত হয় ধর্মঘটের। অপরাধী পরিবহন দুই শ্রমিককে সাজা দেয়ায়ই এ ধর্মঘট ডাকা হয়। এ অবস্থায় দেশবাসী বিরক্ত হয়ে দুরুজাইগ্গাতো বলবেই।
আমরা কি দেখছি? সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মড়ক লেগেছে। কথাটা আমার নয় জাতীয় পত্রিকায় হেডলাইন হয়েছে। ১৭ ফেব্রয়ারী থেকে আজব্দী সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ দিনে আমাদের সড়ক কেড়ে নিয়েছে ১৮১ তাজাপ্রাণ। আহত হয়েছেন আরো শতাধিক ব্যক্তি। রাস্তায় মানুষের জীবন বদ হবার এই পরিসংখ্যানটি আমাদেও আতংঙ্কিত করে বৈকি! প্রশ্ন হলো এভাবেই কি দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মানুষের মৃত্যুর বিভীষিকা চলতেই থাকবে? এখানেই শেষ নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই রাস্তায় নামে পরিবহন শ্রমিকরা। অপরাধ করবে আর সাজা দেয়া যাবে না তা কি করে হয়? আর এ অন্যায় দাবিতেই শ্রমিকরা ধর্মঘট পালনের নামে অরাজকতা করেছে। এমন ধর্মঘট মেনে নেয়া যায় না। সরকার জঙ্গিদমন করতে পারঙ্গম কিন্তু পরিবহন সেক্টরে অসহায় কেন? প্রায় ক্ষেত্রেই পরিবহন শ্রমিকদের অন্যায় দাবিদাওয়া মেনে নিতে দেখি। এবারও হয়তো তাই হবে। সেই আলেঅচিত নৌমন্ত্রীর ডাকে শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রতাহার করে নিয়েছে। তাদেও আস্বস্থ্য করার পরই নাকি ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়। এবারও হয়তো কোন রফাদফা হলো। আলোচিত ব্যক্তিত্ব মিশুক-মনিরের দুর্ঘটনার রায় দিয়েছে আদালত। সচরাচর সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে সাজা খুব কমই হয়। ঐ ঘটনাটি আলোচিত ছিলো বিধায় হয়তো অভিযুক্ত ড্রাইভাবের সাজা হয়েছে। আর তাতেই এতো কিছু। দেশে জঙ্গীরা এ যাবত হাতে গোনা গুটি কয়েক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এরা রক্ষা পায়নি। সরকার জঙ্গীদের দমনে বেশ সক্ষমতা দেখিয়েছে। দেশবাসীও তাতে খুশি। কিন্ত জঙ্গীরা সব মিলিয়ে যত প্রাণ হরণ করেছে আমাদের সড়কে মহাসড়ক এদিনেই তত প্রাণ কেড়ে নেয়। দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্য হচ্ছে। যেদিন লেখাটি লিখছি সেদিনও জনৈক চালক মোবাইল ফোনে কথা বলতে গিয়ে পরিবহনের নিয়ন্ত্রন হারায়। তাতে মারা যায় ৪জন। এটা খুন বলবো নাতো কি বলবো? আদালত কি তার বিচার করবে না? বিচার হবে আইন মোতাবেকই। এজন্য ধর্মঘট করা আইন অবমাননা ছাড়া কি হতে পারে? এ জায়গাটিতে সরকারে সক্ষমতা খুব দরকার। পরিবহন শ্রমিকদের আন্যায় আবদার মেনে নেয়া সরকারের জন্য সঠিক কাজ হবে না। তাতে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে বাড়বে বৈকি!
ছয় :
এইতো সেদিন বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া আদর্শ দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী নাহিদা আক্তারকে কুপিয়ে আহত করেছে হাশেমিয়ার মাদ্রাসার ফাজিল শ্রেণীর ছাত্র শিবির ক্যাডার জাহেদুল ইসলাম। এর আগে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার্থী খাদিজা বেগম নার্গিসকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্যে কোপিয়ে আহত করে। খাদিজা বহু দিন চিকিৎসার পর এখন কিছুটা সুস্থ্য। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ঘরে ঢুকে মুন্নি আক্তার(১৩) নামে এক স্কুলছাত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে এক বখাটে। নিহত মুন্নি আক্তার কালিয়াকৈর উপজেলার কুতুবদিয়া নয়াপাড়া এলাকার শহীদ মিয়ার মেয়ে । সে স্থানীয় চাপাইর বিবিএ উচ্চ বিদ্যালয়ের জিএসসি পরিক্ষার্থী ছিল। ঘাতক আরাফাত গাজীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর বেপারীপাড়া এলাকার আতাউর সরকারের ছেলে। সে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে প্রায় ১ বছর ধরে বিভিন্ন সময় মুন্নিকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে রাজি না হওয়ায় কিছু দিন ধরে রাস্তায় তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতো। এক পর্যায়ে আরাফাত ক্ষুব্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে শ্বাসরোধে মুন্নিকে হত্যা করেছে।
কথা হলো প্রেম আর বিয়ে যেন মামার হাতের মোয়া। চাইলেই পাওয়া যাবে; আর তা প্রত্যাক্ষান করলে আহত কিংবা নিহত করা হবে। ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবির, বখাটে সবাই যেন একট্রা হয়ে এ কাজে নেমেছে। এসব দেখে দেশের মানুষেরাতো রাগে গিয়ে আমার মত ‘দুরুজাইগ্গা’ বলতেই পারে।
সাত :
এদেশে সব কিছুরই যেন দাম বাড়ে; কমে না। রীতিমত মূল্য বৃদ্ধির এক গোলকধাঁধাঁয় পড়েছে দেশের আমজনতা। একবার কোন কিছুর দাম বাড়েছেতো, তা কমেনি কখনো। ব্যবসায়ীরা কথায়-কথায়, দফায়-দফায় জিনিসপত্রির দাম বাড়ায়; এ প্রতিযোগিতায় এখন পিছিয়েনেই খোদ সরকারও। সমস্যা হলো কোন ছুঁতোয় দাম বাড়লে আর কমার নাম থাকে না। জ্বালানী তেলে ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একবার একটু কমেছে। বিশ্ব বাজাড়ের সাথে সঙ্গতি রেখে তেলের দাম আবারও কমানোর কথা। কিন্ত কথা রাখেনি সরকার। কমেনি তেলের দাম। উল্টো কয়েক দফা বাড়ার পর চলতি মার্চ মাসে গ্যাসের দাম বেড়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে কোন ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের বাজারে জ্বালানী তেলের দাম বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার দাম কমলেও তেলের দাম আর তেমন কমেনি। সরকার জ্বালানী তেলের দাম কমাবে বললেও উল্টো গ্যাসের মূল্য বুদ্ধি করেছে। অন্যদিকে তেল নির্ভর বিদ্যুতের দামও নাকি বাড়াবে সরকার। এমনিতেই বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্য জনগনের হাতের নাগালের বাহিরে চলে গেছে। বাজারে সব কিছুর দামই এখন চড়া। এ অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি আগুনের উপর ঘি ঢালার সামিল। আমার জানা মতে বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশের মানুষ কম মূল্যের জ্বালানির সুবিধা পাচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়বে। এ জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সরকারের সিদ্ধান্তে সর্বমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আলোচনার ঝড় বইছে সারা দেশে। সর্বত্র বিরাজ করছে ক্ষোভ-অসন্তোষ। এমন বিরক্তিকর আর অস্থিও পরিস্থিতি থেকে আমরা মুক্তি চাই।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট।
Next > |
---|