বেলাল হোসেন ঢালি
কখনো কখনো ছোট ছোট ঘটনা মানুষের জীবনে আনন্দের বন্যা বয়ে আনে- যা কোটি টাকার বিনিময়ে পাওয়া সম্ভব নয়।
আবার কখনো কখনো ছোট-খাটো ভূল বা অবহেলা চিরদিন মানুষকে আপরাধী বানিয়ে রাখে- যা ইচ্ছে করলেই মন থেকে মুছেফেলা যায়না।
ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। ইতিহাসের ঐতিহ্যে সমৃদ্ব বরিশালস্থ মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার চানপুর ইউনিয়ন আমার জন্মস্থান। অজো পারা গা। যেখানে এখনো ইলেট্রিসিটি নেই। রাস্তা পাকার-তো প্রশ্নই উঠে না। জন্ম থেকে এইচ এস সি পাস পর্যন্ত আমার বেড়ে উঠা এই গ্রামেই। বাবা ঢাকাতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে প্রায়ই ঢাকাতে যাওয়া হতো। কিন্ত, ঢাকার বিশাল বিশাল অস্ট্রালিকা, পিচঢালা রাস্তায় নানা রঙের গাড়ি, লাল-নীল বাত্তি এসব চাকচিক্য কখনো আমাকে আসক্ত করতো না।
আমাদের গ্রামের শেষপ্রান্ত ধরে একটা ছোট্ট নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে ইলিশা নদীর সাথে। এই নদীর পার থেকে আমাদের বাড়ি এত কাছে যে, নদীর পারে দাড়ালে আমাদের ঘরের ভিতরটা পর্যন্ত দেখা যায় । ঠিক এই নদীর পারঘেশে একটি বাজার। বাজারটির নাম ঢালীরহাট। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই বাজারটি শুরু করেন। আগে প্রতি সোম ও বুধবার বিকালে বসতো। এখন প্রতিদিন বসে। তবে প্রতিদিন বিকালে বেশী জমজমাট। গ্রামের কৃষকরা তাদের খেতে ফলানো তাজা সাক-সবজি, গাছের ভিবিন্ন রকমের ফল, পুকুরের তাজা মাছ নিয়ে আসে বাজারে বিক্রি করতে। দেখলেই মন চায় সবগুলি একাই কিনে নেই।
বর্তমানে আমি পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের লীলাভুমি অস্ট্রলিয়াতে বসবাস করছি, তারপরও কেন জানিনা, আমার কাছে আমার জম্মভুমি আমার গ্রাম এবং আমাদের মেহেন্দিগঞ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম জায়গা বলে মনে হয়।
অস্ট্রেলিয়াতে যখন দেখি, এদেশের বিত্তবান মানুষগুলি শহর থেকে কান্ট্রিরি (গ্রাম) সাইটে বসবাস করতে বেশী পছন্দ করে এবং তাদের ঘর-বাড়িগুলো অনেকটা আমাদের দেশের গ্রামের ঘর- বাডির মতো। তখন মনের অজান্তেই নিজেকে নস্ট্রালজিয়ায় হাড়িয়ে ফেলি।
আমি যতবার দেশে যাই বেশীরভাগ সময় গ্রামে থাকি। গ্রামের সবুজতা, নীল আকাশ, নদী, ফুল, প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, রাস্তার দু'পাশে ঢেউ খেলা ফসলের দিগন্ত এসব নয়নাভিরাম দৃশ্য আমাকে খুব কাছে টানে। যার মাঝে আমার আমিকে খুজে পাই।
একদিন সকালে নদীর পারে বসে ভিটামিন ডি নিচ্ছি। ডাক্তার বলেছে, আমার শরীরে ভিটামিন ডি'র খুব অভাব। সকালের সূর্যের আলোতে নাকি প্রচুর পরিমান ভিটামিন ডি থাকে। ভিটামিন ডি মানুষের শরীরের হাড় ক্ষয়রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং মস্তিস্ক সতেজ রাখে।
"মানুষ মানুষের জন্য
জীবন জীবনের জন্য
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু...."
আমার মনে হলো ধান ক্ষেত থেকে আমার মস্তিস্কে পোকা ঢুকেছে। আমি শুনতে পাচ্ছি এই সাজ-সকালে ভুপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানটি। আমি চারিদিকে খুঁজি কিন্তু কোথাও কেউ নেই।
পোকা নয়, সত্যি সত্যি। দূর থেকে ছোট্ট একটা ডিঙ্গি নৌকা ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। নৌকার ছাউনির ভিতরে কেউ আছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। তবে এটা বুঝা যাচ্ছে ভিতরে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। নৌকার মাঝি লোকটা মধ্যবয়সী। এই বয়সে, এই লোকটা সাজ-সকালে ক্যাসেট প্লেয়ারে ভুপেন হাজারিকার গান শুনছে! কে জানে- কার মনে কি আছে? নৌকাটা আস্তে আস্তে দৃশ্যান্তর হয়ে যাচ্ছে। গানের সুর ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু কান্নার শব্দ বাড়ছে! মনে হল নৌকার ছাউনির ভিতর কোন বাচ্চা-কিন্তু না, আমার ঠিক পিছনেই কেউ হিছকি দিয়ে কান্না করছে। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় ইয়া বড় একটা বস্তা। বস্তাটার জন্য ছেলেটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি উঠে ছেলেটার মাথা থেকে বস্তাটা নামিয়ে ফেললাম। বস্তাটা নামাতে আমারই বেশ কস্ট হচ্ছিলো। বিশ কেজিরও বেশী হবে। মনে মনে ভাবছি- ছেলেটার বাবা-মা কেমন মানুষ! এতটুকু একটা বাচ্চা ছেলে, বয়স আনুমানিক দশ-বার হবে। এত ওজনের একটা বস্তা কি করে এই ছেলেটার মাথায়-হটাৎ ছেলেটা কান্নার মধ্যেই অনেকটা ধমকের সুরেই বললো-
আমার বোস্তা নামাইলেন কেন? আমি একটু বিস্মিত হইলাম। ভাবলাম-ছেলেটাকে সাহায্য করতে গিয়ে কী ভুল করে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম-
- কেন, তোমার কস্ট হচ্ছিল তাই-
- আমার কস্ট হইবো কেন?
- তাহলে তুমি কান্না করছিলে কেনো?
-ধান ভাঙাইতে মায় আমারে পঞ্চাশ টেহা দিছিলো। হাটে গিয়া দেহি টেহা নাই। কই জানি টেহা পইড়াগেছে। বলেই আবারো হেছকি দিয়ে কানতে লাগলো। আমি ওকে শান্তনা দিয়ে বললাম-
-আচ্ছা থামো, তোমার টাকা পাওয়া যাবে।
-কেমনে পামু? হারারাস্তা খুইজ্জা আইছি।বাড়িত গেলে মায় আমারে মাইরা হালাইবো। আবারও কান্না। অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ছেলেটাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম।
ছেলেটার নাম জামাল। বাড়িতে ওর অসুস্থ মা ও ছোট্ট একটা বোন আছে। ওদের বাড়ী আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। আর উপজেলা বাজার আমাদের বাড়ী থেকে আরো প্রায় আড়াই কিলোমটার। প্রায় সাড়েতিন কিলোমিটার রাস্তা এই বাচ্চা ছেলেটা বিশ কেজি ওজনের বস্তাটা নিয়ে উপজেলা বাজারে গিয়ে টাকার জন্য ধান ভাঙ্গাতে না পেরে আবার বাড়ি ফেরত যাচ্ছে। তারপর বাড়িতে গিয়ে টাকা হারানোর দায়ে মায়ের হাতের বকা কিংবা মাইর। এসব চিন্তায় জামালের বুকটা দুক দুক করছে। ভয়ে মুখটা মলিন হয়ে আছে। কান্না করতে করতে চোখ-মুখ ফুলে গেছে।
জামাল পথের মাঝে প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে একবার জঙ্গলে গিয়েছিল। ওর টাকাটা হয়তো সেখানেই হারিয়েছে। জামাল সেখানে গিয়েও খুজেছে, কিন্ত পায়নাই।
ওইদিকে বাড়িতে অসুস্থ মা অপেক্ষা করছে- কখন ছেলে ধান ভাঙিয়ে চাউল করে বাড়ি ফিরবে, তারপর হয়তো ভাত রান্না করবে...বাচ্চাদের খাওয়াবে...নিজে খাবে... ।
অনেকদিন পর দেশে আসা। শীতের সকাল। বাড়ির সবাই আমার জন্য নাস্তা বানাতে ব্যাস্ত। নাস্তার টেবিলে হরেক রকমের পিটা, ডিম-রুটি-কলা...। খাবার টেবিলটা দেখলে মনে হবে পিঠামেলার একটা স্টল।
জামালকে বললাম-বসো, নাস্তা খাও।
কিন্ত না, জামালের খাবার প্রতি কোন লোভ বা আগ্রহ দেখা গেল না। একটু অবাক হলাম। একটা গরিবের ছেলে, এত লোভনীয় খাবার দেখেও তার কোন লোভনীয় অনুভুতি নেই। মুখটা গোমরা করে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা চেয়ার টান দিয়ে বসতে বললাম, কিন্তু না, সে বসল না। সে মাথা নত করে খুব সাহস করে বলল-
-আমি খামু না। পারলে আমারে পঞ্চাশটা টেহা দেন। আমি কাম কইরা শোধ কইরা দেব।
- আচ্ছা দিমু। আগে তুমি খাও।
-না, আগে টেহা দেন। ধান ভাংগাইতে না পারলে মায় আমারে...আবারও কান্না।
আমি ঘর থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এনে জামালের হাতে দিলাম। সাথে সাথে জামালের সমস্ত শরীরে ইন্দিয়গুলো জেন সজাক হয়ে গেল। শুকনা কোমল মুখখানা খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। এমন হাসি সচরাচর দেখা যায় না। এ জেন মোনালিসার হাসিকেও হার মানাবে।
সামান্য পঞ্চাশ টাকায় একজন মানুষের এত সুখ কিনা যায় আমার জানা ছিল না।
জামালের মুখের হাসিটা যদি সেদিন ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতে পারতাম। আজকে ফেইসবুকে আমার এই লেখাটা না দিয়ে জামালের সেই হাসিমাখা মুখখানা যদি দিতাম, তাহলে আমার এই লেখার চেয়ে ঢের বেশি লাইক পেতাম।
অস্ট্রেলিয়াতে আছি বিশ বছরেরও বেশি।
এই বিশ বছরে ভাই-বোন, আন্তীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে বিভিন্ন সময়ে, ভিবিন্ন প্রয়োজনে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েছি। কাউকে কি খুশি করতে পেরেছি? কিন্তু মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিয়ে জামালকে খুশি করতে পেরেছিলাম। চরম খুশি। যা কোটি টাকা দিয়েও সম্ভব নয়।
গ্রামে আছি প্রায় দু'সপ্তাহ হয়ে গেল। এবার ঢাকা ফিরে যাবার সময়। যাবার আগের দিন বিকালে পুকুরঘাটের পাকার উপর বসে আছি। রোদেলা সোনালী আকাশ। পড়ন্ত বিকালের ক্লান্ত সূর্যটা ডুবি ডুবি ভাব। আমাদের বাজারটা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। চারিদিক থেকে লোকজন আসছে। আবার অনেকেই বাজার শেষ করে বাড়ি ফিরছে। হটাৎ চোখে পড়ল, লালছে হ্লুদ রঙের গেঞ্জি পড়া ছোট্ট একটা ছেলে মাথার উপরে একটা সাজি নিয়ে বাজারের দিকে আসছে। পিছনে এক বৃদ্ধা মহিলা লাঠিভর করে কুজো দিয়ে হাটছে। ছেলেটা যতই কাছে আসছে ততই ছেলেটার বুকের ঠিক মাঝখানে কাঙ্গারুর ছবিটা পরিস্কার হয়ে উঠছে। আমার আর বুজতে বাকি রইলো না যে এটা জামাল। সেদিন পঞ্চাশ টাকার সাথে জামালকে কাঙ্গারুর ছাপের অস্ট্রেলিয়া লেখা এই টি-শার্টটাও দিয়েছিলাম। টি-শার্টটায় জামালকে ভালই মানিয়েছে। নিশ্চয়ই জামাল বাজারে যাচ্ছে কিছু বিক্রি করার জন্য। কিন্ত না, জামাল বাজারের দিকে না গিয়ে আমাদের বাড়ির রাস্তা ধরে এদিকে আসছে। জামালের সাথে বৃদ্ধা মহিলাও আসছে। মনে মনে ভাবছি, জামাল কী আমাদের বাড়ি মানে আমার কাছেই আসছে? কিন্তু কেন? সাথে বৃদ্ধা মহিলা কে? জামালের মা নাতো? এই কেনোর উত্তর একটাই, জামালকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি এখন মাকে সাথে নিয়ে আসছে নিশ্চই আরো কিছু সাহায্য চাইতে। গরীব মানুষকে সাহায্য করলে একটাই সমস্যা বার বার আসবে।
একবার বরিশাল শহরে বেড়াতে গিয়ে ভাবলাম, আজকে সারাদিন রিক্সায় বেড়াবো। যেই কথা সেই কাজ। রিক্সায় উঠে বসলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, রিক্সাওয়ালাকে একটা সারপ্রাইজ দিবো। জিঙ্গেস করলাম, ভাই, আপনার একদিনের সর্বচ ইনকাম কতো? রিক্সাওয়ালা বলল, দিন ভালো গেলে মালিকের জমা-টমা দিয়া তিন-সাড়েতিনশো পাই ছার। সুযোগ পেয়ে আপন মনে সব কিছু বলতে শুরু করলো- ব্যবসা ভালা না ছার, সব কিছুর যেই দাম, রিক্সা চালাইয়া সংসার চালান দায় হইয়া গেছে ছার.... ।
বরিশাল শহর খুব ছোট। ট্রাফিকজাম নাই বললেই চলে। দু' ঘন্টা ঘোরার পর বাসায় চলে এলাম। পাঁচশো টাকার একটা নোট রিক্সা চালকের হাতে দিয়ে নেমে পড়লাম।
-ছার, ভাঙ্গতি নাই।
- দেওয়া লাগবে না। রেখে দিন।
রিক্সা চালক চট করে একবার আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন। কারণ, আমাকে দেখতে মোটেও বড়লোক মনে হয় না। আমার মত একজন হাদারাম এরকম পুরো পাঁচশো টাকা দিয়ে দিবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে মনে মনে ধরে নিয়েছে দেখতে বড় লোক না হলেও আমার অনেক টাকা-পয়সা আছে। চট করে দুইহাতে আমার ডান হাত চেপে ধরলো।
-ছার, টেহার লইগা আমার মাইয়াডারে বিয়া দিতে পারি না। আমনে আমার মাইয়াডার.....।
আমার মেজাজটা খুবই খারাপ হলো। ইচ্ছে করছিলো হাত থেকে টান দিয়ে টাকাটা নিয়ে সঠিক ভাড়াটা দিয়ে কেটে পরি। কিন্তু, পারলাম না। টান দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে- সরি বলে চলে গেলাম।
জামাল আর জামালের মাকে দেখে ঘটনাটা মনে পড়ল। সেইবার রাস্তায় থাকাতে রিক্সাওয়ালার কাজ থেকে কেটে পরা সম্ভব হয়েছিল। এবারতো সরাসরি বাড়িতে।
জামাল তার মাথা থেকে সাজিটা নামিয়ে রেখে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। জামালের মা হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে দুইহাতে আমার হাত দুইটা খুব শক্ত করে চেপে ধরলো।
- বাবা আমনে মানুষ না। ফেরেস্তা। আমনে আমার ছেলের লইগা যা করেছেন এই জমানায় কেহ করে না। হেইদিনের পর থেইকা আমনের লগে দেহা করনের লইগা আমার পরানডা ছটফট করতেছিলো। কিন্ত আইতে পারিনাই। শরীরটা খুবই খারাপ। রাইত অইলে খালি জ্বর ওঠে। কাশির জালায় কিছুই- খুক খুক কাশির জন্য ঠিকমত কথা বলতে পারছিল না। তারপরও বলেই যাচ্ছে-
-জামাল কইলো, আমনে নাকি কাইলকা বিদেশ যাইবেন গিয়া তাই আর না আইয়া পারলাম না। বলেই আবারো কাশতে লাগলো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
বাজারের মানুষজন কমতে শুরু করেছে।
জামালের সাজির ভিতরে কাচাপাকা বড় বড় দুইটা পেপে, তিন-চাইরটা জাম্বুরা, অনেকগুলি আমড়া ও কামরাঙ্গা। দেখলেই বুঝা যায় এইমাত্র গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে আসছে। নিশ্চই এইগুলি বিক্রি করে জামালদের সংসার চলে। একবার ভাবলাম ফলগুলি কিনে রাখি। আবার কেন জানি মন সায় দিল না। জামালকে বললাম- জামাল, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি বাজারে না গেলে তোমার ফলগুলি বিক্রি করতে পারবে না।
জামালের মা হায় হায় করে উঠলো-
-আরে বাজান এইডা আমনে কি কন? এইগুলান আমি আমনের লইগা আনছি। বাজান, আমার বাপমরা পোলাডারে আমনে- মহিলা ঝর ঝর করে কেঁদে দিল।
-বাজান, আমি আইছি আমনেরে দাওয়াত দিতে। আমনে আমার গরীবের বাড়িতে একবেলা ডাইল-ভাত খাইবেন।
কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমতা আমতা করে বললাম-
-ইয়ে না মানে... আমিতো আগামীকাল চলে যাব... তাছাড়া...
-বাজান, আমরা গরীব হইলে কী হইবো, আমনের অযত্ন হইবো না। আমনে- কাশির জন্য আর বলতে পারলো না।
খুব অবাক হলাম, আমাদের ভাবনা আর এই গরীব মানুষগুলোর চিন্তা ভাবনায় কত তফাত।
সেইদিন জামালকে মাত্র পঞ্চাশ টাকা, দশ ডলারের একটা গেঞ্জি আর ওর মা ও ছোট বোনের জন্য সামান্য কিছু পিঠা দিয়েই নিজেকে বিশাল দানবীর ভেবেছিলাম। অথচ গ্রামের এই গরীব মানুষগুলি কত উদার। অন্যের জন্য, বিনা স্বার্থে তাদের শেষে সম্বলটুকু দিয়ে দিতেও কোন কার্পণ্য করে না।
আমি জামালের মাকে ধরে নিয়ে ঘরে বসাইলাম।
-চাচি, আপনার কাশিটা ভাল না। ভাল দেখে একজন ডাক্তার দেখান।
-ডাক্তারতো দেখাই বাজান। ওষুধ খাইলে একটু ভালা থাকি। ওষুধ শেষ হইলেই আবার মরি। আর কত ওষুধ খামু বাজান।
ডাক্তার কয় ঢাকা গিয়া বড় ডাক্তার দেখাইতে। ঢাকা যামু, বড় ডাক্তার দেখাইমু, এত টেহা কই পামু? মরতেতো
একদিন হইবোই। দোয়া কইরো যেন বাপমরা পোলা আর মাইয়াডারে একটু মানুষ কইরা মরতে পারি।
যাবার সময় আমি খুব চুপ করে জামালের হাতে পাঁচশো টাকার দুইটা নোট গুজে দিলাম। চুপ করে দিলাম কারণ, জামালের মা যাতে মনে না করে যে, আমি তার নিয়ে আসা ফলগুলির দাম দিচ্ছি।
আমার বয়স যখন জামালের মত আমার মারও তখন যক্ষ্মা হয়েছিল। আমার মা'ও
জামালের মা'র মত সুকিয়ে কাট হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা তখন ঢাকাতে চাকরি করতেন। বাবা, মাকে ঢাকা নিয়ে যক্ষ্মা হাসপাতালের বড় ডাক্তার, ডা: রশিদ আহম্মেদকে দেখান। ঠিক ছয়মাস ওষুধ খাওয়ার পর আমার মা সর্ম্পুণ সুস্থ হয়ে যান। আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় আমার মা এখনো সুস্থ।
যদিও আমি ডাক্তার না তবু আমি নিশ্চিত জামালের মার যক্ষ্মা হয়েছে। চেহারা দেখলেই বুঝা যায় যতটা না বয়স তার চেয়ে বেশী বুড়িয়ে গেছে। চোখ দুইটা
গর্তের ভিতরে চলে গেছে। না ঘুমাইয়া চোখের দুইপাশে কালো হয়ে গেছে।
এখনই ঢাকা নিয়ে চিকিৎসা না করাইলে জামালের মা বেশী দিন বাঁচবে না। কিন্ত কে করাবে জামালের মার চিকিৎসা। একবার ভাবি, আগামীকাল আমার সাথে জামালের মাকে ঢাকা নিয়া গেলে কেমন হয়। কিন্তু ভয় হয় পাছে লোকে কি বলে। তাছাড়া ঢাকাতে জামালের মাকে নিয়ে রাখবো কোথায়? আমি উঠেছি আমার ছোট ভাইয়ের বাসায়। ছোট্ট দুই বেড রুমের বাসা। আমি একাই দখল নিয়েছি মাস্টার বেডরুম। ছোট ভাই, তার স্ত্রী, ওদের তিন সন্তান ও আমার মা একটা ছোট্ট রুমে গাদাগাদি করে থাকে। তারমধ্যে আমি আসাতে আমার অন্যান্য ভাই-বোনরাও এসেছে। তারাই লাউঞ্জে ফ্লরিং করে। এর মধ্যে একটা অসুস্থ যক্ষ্মা রুগীকে নিয়ে.....।
যদিও ঢাকাতে আমার ছোট্ট একটা বাড়ি আছে। কিন্তু বাড়ির সবগুলি ইউনিট ভাড়া দেওয়া। ভাড়াটিয়া উঠাইয়া সেখানে জামালের মাকে উঠানো কি সম্ভব?
অনেক সময় ইচ্ছে করলেও মন যা চায় তা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। জামালের মার মত কত অসুস্থ মা বাংলার আনাছে- কানাছে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরছে কে তার খোজ রাখে।
এরপর দেশ থেকে অস্ট্রলিয়ায় এসে তিন বছর ছিলাম। সেই তিন বছরে যতবার জামালের কথা মনে পড়েছে, জামালের
হাসিমাখা মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ততবারই জামাল আমাকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু-...।
তিন বছর পর আবার দেশে গেলাম।একদিন বিকালে গ্রামের বাড়িতে নিজের রুমে শুয়ে আছি। ছোট ভাই ডেকে বলল, একটা ছেলে আসছে আমার সাথে দেখা করতে। উঠে গিয়ে দেখি জামাল। যদিও গত তিন বছরে জামালের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। স্বাস্থ্য ভাল হয়ে জামাল এখন তরতাজা এক যুবকের মত। চেহারায় অনেক লাভন্য। গোল ভরাটে মুখখানায় খুশি খুশি ভাব। দেখলেই মনে হয় জামাল অনেক সুখে আছে। জামাল এবার আর আমার পা'ছুঁয়ে সালাম করল না। মুখে সালাম দিল। আমি সালামের উত্তর দিয়ে জিঙ্গেস করলাম, কেমন আছ জামাল?
-জি ভালো আছি ভাইজান। আমনে ভালো আছেন?
-ভাল। তোমার মা কেমন আছে?
জামাল কিছুই বলল না। ভাবলাম, জামাল হয়তো আমার কথা শুনে নাই। আবার জানতে চাইলাম, এবারো জামাল কিছু বলে না দেখে ওর মুখের দিকে তাকাইলাম। একটু আগেই যেই জামালের মুখখানা খুশিতে জ্বলজ্বল করছিলো সেই মুখখানা অন্দকার হয়েগেছে। চোখে পানি ছলছল করছে।
-জামাল, তোমার মা কী অসুস্থ?
-না।
-তাহলে?
-আমার মার যক্ষ্মা হইছিলো, গ্রামের ডাক্তার কইছে ঢাহা নিয়া চিকিৎসা না করাইলে বাঁচবো না। কিন্ত, ঢাহা গিয়া কই থাকুম, কই খামু, আর মায়রে চিকিৎসা করানের টেহাই কই পামু? মায় আমার টেহার লইগা বিনা চিকিৎসায় মইরা গেল।
........
জামালের চোখ থেকে দুই ফোটা পানি টশ টশ শব্দ করে আমার পায়ের কাছে মাটিতে পড়ল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম মাটির নীচ থেকে জামালের মা খুক খুক করে কেশে উঠল। গলাদিয়ে ধরধর করে রক্ত পড়ছে। ঘরের ভিটা লাল রক্তে ভেসে গেল। জামালের মা বলে উঠলো- বাজান, আমাকে ঢাহা নিয়ে চিকিৎসা করানের মতো অবস্থা তোমার আছিলো। আমি শরমে কই নাই। তুমিকি আমার কস্টটা বুঝতে পারোনাই?
দায়িত্বহীনতার জন্য লজ্জায় আর আপমানে জামালের সামনে আর এক
মুহূর্ত থাকতে পারলাম না। নিজের রুমে গিয়ে খাটের কর্ণারে বালিশের উপর মাথা রেখে ঘরের খোলা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই চোখে পড়ল আমাদের শান্ত, স্নিগ্ধ টলমলে জলে অবগাহন ছোট্ট নদীটা। মনে পড়ল দুই বছর আগের সেই ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় ক্যাসেট প্লেয়ারে ভুপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানের কথাগুলি। মনে মনে ভাবি, এই সুন্দর ভুবনে কার মনে যে কিসের কষ্ট? কত কষ্ট? কেউ জানে? জানতে চায়?
পৃথিবীর মানুষগুলি খুবই স্বার্থপর! নিষ্ঠুর! সবাই নিজেকে নিয়ে এতই ব্যস্ত যে চারপাশে তাকানোর সময় কারো নেই। কেউ বিত্তের পাহাড় গড়ছে। কেউ সামান্য
অর্থের জন্য বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। তাইতো কবিরা লিখেন। শিল্পীরা গান। কিন্তু আমরা? শুধুই শুনি! একবার যদি উপলব্ধি করতাম-
'মানুষ মানুষের জন্য
জীবন জীবনের জন্য
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু ....
< Prev | Next > |
---|