আউয়াল খান:
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি সিডনিতে ‘মাতৃভাষা রক্ষা’-এর উপর যৌথভাবে বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করেছিল অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট পাবলিক লাইব্রেরী ও অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এম এলসি মুভমেন্ট ।
সকাল থেকেই নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট পাবলিক লাইব্রেরীর এই সেমিনারে অংশ নিতে ভাষাতত্ত্ববিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বহুভাষাভাষী তরুণ-তরুণীর আসতে থাকেন । এই সময় তাদেরকে অনুষ্ঠান স্থলে স্বাগত জানান এম এলসি মুভমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এনাম হক।
সপ্তর্ষি তিথন পালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রথমে নিউ সাউথ ওয়েলস'র সদ্য পদত্যাগী প্রিমিয়ার মাইক বেয়ার্ডের ভাষন পড়ে শোনান স্টেট পাবলিক লাইব্রেরীর সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য থাঙ্ক ইনগো এরপর অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণের কারক্রম তুলে ধরেন ম্যালিসা জ্যাকসন।," আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য, গুরুত্ব ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ" নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট লেখক ডঃ রতন কুন্ডু।
"বিশ্বব্যাপি আংশকাজনক ভাবে ভাষার বিপন্নতা রুখতে কমিউনিটির অংশগ্রহণ"র উপর মূল প্রবন্ধ উপস্হাপন করেন অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রখ্যাত ভাষাতত্ববিদ মার্ক জুকারম্যান।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কেন ক্রুশেনক আলোচনা রাখেন "মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক নতুন ভাষা শিক্ষা", আর অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম জাতীয় গণমাধ্যম এসবিএস'র অডিও এবং ভাষা বিষয়বস্তুর স্পেসিয়াল ব্রডকাস্টিং সার্ভিস এর পরিচালক মান্দি উইকস আলোচনা রাখেন "এসবিএস'র জাতীয় ভাষা প্রতিযোগিতা" উপর।
"নতুন ভাষা শিক্ষার সেরা উপায়" উপর আলোকপাত করেন "বিশ্বের বিপন্ন মাতৃভাষায় রক্ষা করার জন্য এম এলসি মুভমেন্টে প্রয়োজনীতার" উপর আলোচনা রাখেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম (এন আই) খান।
ওরিয়ানা এসিভেডও আলোচনা করেন নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট পাবলিক লাইব্রেরী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে।
সবশেষে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মাদার ল্যাংগুয়েজেস কনসারভেশন মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসনস ও সিডনির এসফিল্ড পার্কে নির্মিত বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মনুমেন্টের প্রধান রূপকার এবং ‘একুশে কর্নার’ দর্শনের প্রবক্তা নির্মল পাল।
পৃথিবীতে ৭-৮ হাজার ভাষার প্রচলন থাকলেও এরই মধ্যে শতকরা আট ভাগ ভাষা হারিয়ে গেছে। ভবিষ্যতে শতকরা ১০ ভাগ ভাষা বেচে থাকবে। বাকি ৯০ ভাগই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশে ৪১টি ভাষা থাকলেও অনেকগুলোরই এখন কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যে ভাষা জানা থাকলে আর্থ-সামাজিকভাবে লাভবান হওয়া যায় লোকজন সেসব ভাষাকেই গ্রহণ করছে। আর যেসব ভাষা রাজনীতি, ব্যবসা ও প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত নয় সেগুলো থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
সেমিনারে আলোচকগন বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন " দৃশ্যমান বস্তুর বিলুপ্তি সবাই দেখতে পাই যেমন পৃথিবীতে আগে এমন অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল কিন্তু এখন আর নেই। মানুষ এগুলোর ব্যাপারে সোচ্চার কারন এগুলো দৃশ্যমান কিন্তু তারা ভাষা বিলুপ্তির ব্যাপারে সোচ্চার নয়। কারন এটি দৃশ্যমান নয়।পৃথিবীতে মধ্যে শতকরা আট ভাগ ভাষা হারিয়ে গেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে শতকরা মাত্র দশ ভাগ ভাষা বেচে থাকবে। বাকি সবই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ভাষার এই বিলুপ্তিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বই যে শুধু হুমকির মুখে পড়বে তা নয়, ওইসব জনপদের প্রাচীন ইতিহাস, প্রমাণ দলিল ও পুরনো পুঁথিতে সঞ্চিত জ্ঞানও হারিয়ে যাবে। এতে মানসিক স্বাস্থের ক্ষতি সহ এর নেতিবাচক প্রভাব হবে সদূরপ্রসারী যা আমরা ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের প্রান্তে তা দেখতে পাচ্ছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষক ,পেশাজীবী সম্প্রদায়ের ও পরিবারের ব্যাপক ভূমিকা এবং সর্বোপরি এই সমস্যা থেকে উত্তরণে জন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
উল্লেখ্য যে বিশ্বের সকল মাতৃভাষাকে রক্ষার করতে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে গত ১০ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এম এলসি মুভমেন্টে কাজ করে যাচ্ছে। মহান‘একুশের চেতনা’বাস্তবায়নে সংগঠনটি মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে ।তারই অংশ হিসাবে এই সেমিনারটি আয়োজন করা হয়।
এছাড়া ও আগামী ২৮শে ফেব্রুয়ারি’১৭ তারিখে ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার’ প্রতিষ্ঠা’র বিষয় নিয়ে আরেকটি বিশেষ সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে।
< Prev | Next > |
---|