রতন কুন্ডু
( কৈশোর পর্ব )
সোনাই, কাসার থালায় মাস্টারমশাইর জন্য সকালের জল খাবার নিয়ে আসে। দরোজার বাইরে থেকে খাবার থালা আর কাসার গ্লাসে এক গ্লাস জল বৈঠকখানায় ভেতরে রেখে খুব সন্তর্পণে বাইরে পা রাখে। যদুনাথ আড়াল থেকে দেখে কিন্তু কিছু বলেনা। এর পর সোনাই একটū আস্তে করে গলা ঝাড়বে। সলজ্জ বলবে- মাস্টারমশাই, আপনার জল খাবার। বলেই ব্যস্ত পায়ে ভেতরের বাড়িতে চলে যাবে। যদুনাথ জানে সোনাই আবার ফিরে আসবে। পেছনের টিনের বেড়ার ছিদ্র দিয়ে তার জলযোগ দেখবে নিবিẵ মনে। যদুনাথ মনে মনে হাসে। কারুর তৃপ্তিতে অন্য কেউ পরিতৃপ্ত হয় ভেবে অবাক হয়। পৃথিবীটা কত বিচিত্র! এর মাঝে গণেশ ক্রমে উপস্থিত হয়। দরোজার গায়ে স্ফীত পেটটি ঠেকিয়ে দাড়ায়। যদুনাথ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করেন -কিরে কিছু বলবি? গণেশ পেটে হাত বুলায়। মুখের সঞ্চিত লালা এক ঢোকে গিলে ফেলে।
আজ্ঞে, আপনি জলযোগ করেন মাস্টারমশাই। আমিও চারটে সেবা করে আসি। বলতেই যদুনাথ এর কান খাড়া হয়ে যায়। চোখ দুটো বড় হয়ে যায়।
-এই এদিকে আয়। গনেশ কাছে আসতেই তার গাŴল ঠাস করে এক থাপ্পর মারে। গণেশের গালটা লাল হয়ে যায়। প্রতিবাদ করে
-মাস্টারমশাই, আমারে মারলেন কেন?
মাস্টারমশাই হাতের থালাটা নামিয়ে রেখে বিশেষজ্ঞের মত বল্লেন-
-তুই বলছিস সেবা করে আসি। এই কত বড় অপরাধ কŴরũছস? তুই হũল এ বাড়ির কামলা। তুই কি এটা বলতে পারিস? সেবা করেন এ বাড়ির কর্তা। আমরা সবাই ভক্ষণ করি, আর তোরা বলবি- দুটো গিলে আসছি। কি মনে থাকবে? গণেশ বুঝে হোক না বুঝে হোক মাথা দুলিয়ে কাস্তে দিয়ে পিঠ চুলকাতে চুলকাতে নিষ্ক্রান্ত হয়।
একে একে সুবিমল, নি¤র্œল, জগাই, মোতালেব, কল্পŭ আর মহম্মদ বৈঠক খানায় ঢুকে। মাস্টারমশাই কোরাস প্রার্থনা শুরু করতে বললেই সবাই সমস্বরে আবৃত্তি করে-
ছŭটব খেলব হাসব, সবাই ভালো বাসব,
গুরু জনকে মানব সবাই ভালো জানব...
সবাই একে এক গুরুজীকে প্রণাম করে গোল হয়ে বসে। যদুনাথ, যাদব বাবুর পাটিগণিত এর ভাজ খেলেন।
-সেট পেন্সিল বের কর সবাই। একটি সমাধান কর:
বনে মহিষ, চন্দ্রে ঘোড়া, অর্ধচন্দ্রে পাঠাজোড়া,
ডাইকা বলে শ্মশান কালী একশ টাকায় একশ' বলি।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলছি প্রাচীন গণিত কবিতার ছন্দেই তৈরী হত । আর সংখ্যা তত্ত্ব উপমার মাধ্যমে মস্তিস্কের কোষে কোষে সঞ্চারিত হত-
একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ (শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষ) তিনে নেত্র (স্বাভাবিক দুই চোখ সাথে অন্তরচক্ষ-ু মহাদেবের অবয়বে বিদ্যমান) চারে-বেদ (ঋক, শাম, যযŬ ও অথর্ব) পঞ্চবান (আমি জানিনা) ছয়ে ঋতু (সবাই জানে), সাত সমুদ্র (বইয়ের কথা) অস্টবসু (রাজা শান্তনুর ¯ত্রŪ, জলকন্যা মৎস্যগন্ধার ৭টি সন্তান প্রত্যয় মতবক গ΅Ũয় বিসর্জণ ųদয়ার পŴর অẵম সЮŨন বংশ রক্ষŨ কŴর। নŴয় নবগ্রহ ও দŴশ দিক (পůর্ব, পũẮম, উত্তর,দক্ষিন, অগ্নি, বায়ু, ঈশান, ŵনঋত, উধŦ ও অধঃ) সে হিসাবে যদūমŨষ্টŨর যে গাণিতিক ধাঁধা দিয়েছেন তার সরলীকরণ করলে এই দাড়ায় যে একটি মহিষের মূল্য ৫ টাকা (পঞ্চবান) একটি ঘোড়ার মূল্য ১ টাকা (একে চন্দ্র) এবং আট আনায় (পঞ্চাশ পয়সা) পাওয়া যাবে দুটি পাঠা। শ্মশান কালীর ইচ্ছা একশ'টি বলি গ্রহণ করা। আয়োজকদের বাজেটও ১০০টাকা। অর্থাৎ তুমি কিভাবে একশত টাকার মধ্যে ১০০টি প্রানী কিনতে পারবে সে হিসাবটি দিতে হবে।্ যদু মাস্টার এর প্রিয় ছাত্র নি¤র্œল গণিতে কাঁচা। পক্ষান্তরে সুবিমল কাঁচা-পাকা। সুবিমল যখন হিসাব কষে গুরু মশাইর দিকে সেøট এগিয়ে দেয় তখন অন্য সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে। এবার মাস্টারমশাই দ্বিতীয় গাণিতিক ধাঁধা নিয়ে আসেন-
আছিল দেউল বিচিত্র গঠন
ক্রোধভরে ফেলে দিল পবন নন্দন.
অর্ধেক প;েতে আর তদর্ধ জলেতে
দুই হাত জেগে আছে জলের উপরে।
হসাব করে বলতে হবে দেউলটি কতহাত লম্বা ছিল। অপেক্ষকৃত সহজ এই ধাঁধাটি অধিকাংশ শিশ্যরাই সহজে করে ফেলতে সক্ষম হয়। তামাকের তৃষ্ণা পাওয়াতে যদুনাথ জগাইকে আদেশ করেন
বাবা জগাই। ছিলিমটা বানিয়ে আনো গে।
জগাই মহাখুশি। ছিলিম বানানোর সুযোগে দুই একটা সুকটান দিতে পারে।
অর্থের হিসাব হŴতŨ ট;ায়। এক টঙ্কায় (এক টাকায়) ষোলো আনা। পর্যায়ক্রমে হিসেব মেলানোর জন্য টাকা, আধুলি, সিকি, পয়সা, গন্ডা, কড়া, ক্রান্তি, ধুল ও দন্তি পর্যন্ত বিস্তৃত। মাস্টার মশাই এবার জমির হিসাবের বই খুলেন। আংগুল তুলে মহম্মদকে বলেন
-এই বলতো কত ছটাকে এক কাঠা?
মহম্মদ মাথা নীচু করে বসে থাকে। যদুনাথের হাতের বেত নড়ে চড়ে ওঠে
-এই হাত পাত। মহম্মদ বাধ্য ছাত্রের মত হাত বাড়াতেই সপাং করে একটি বেতের বাড়ি। হাতটা ব্যাথায় কুকুড়ে যায়। মহম্মদ হাত ডলতে থাকে আর চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পরতে থাকে।
-আরে গাধা যোলো আনায় ১ টংকা হলে ষোলো ছটাকে এক সের হলে কত ছটাকে এক কাঠা? সবাই সমন্বয়ে বলে ষোলো ছটাকে এক কাঠা।
কত কাঠায় এক বিঘা? পাঁচ কাঠায় একক বিঘা। কত বিঘায় এক কানি? এর মŴধ্য জগাই নারকেলের খোল আর চালতা গাছের নৈচায় তৈরী হুক ‹ার উপরে মাটির তৈরী কলকেতে ফু দিতে দিতে পাঠশালায় প্রবেশ করে। যদুনাথের জিভ ভিজে ওঠে। শুরু করার আগে জিভটা দুঠোটের চারপাশে ঘুড়িয়ে সিক্ত করে নেয়।
এর পর শুরু করেন স্বর্ণের হিসাব
এই কẦŬ স্বর্ণের অŨর্যাটা বলতো?
কল্পনার ডাকনাম কল্পু, মাথা একেবারে খারাপ না। কোন কিছু একবার শুনলে মনে রাখতে পারে। দাড়িয়ে বাইরে বড়ই গাছে টানানো খালি জের টিনের এর ঘন্টার (কাকতাড়ūয়া) দিকে তাকিয়ে বলে-
ছয় রত্তি দিলে পরে এক আনা হয়
এইভাবে ষোলো আনার এক ভরি কয়।
একভরি একতোলা স্বর্ণের ওজনে
পাঁচতোলায় এক ছটাক এটা সবাই জানে।
চার ছটাকে এক পোয়া জানিবে নিশ্চয়
দুই পোয়ায় আধা সের অন্য কিছু নয়।
ষোলো ছটাকে ųযমন হয় এক সের
চল্লিশ সেরে এক মন নয় হের ফের।
মাস্টারমশাই খুব প্রীত হন। কল্পুকে কাছে ডেকে পিঠে হাত বুলিয়ে আর্শীবাদ করেন
মা, তোমার ভাগ্যে যেন এক বড় ব্যবসায়ী পাত্র জোটে। সর্বে ভবন্ত সুখিনৎ। দেখতে দেখতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। যদুনাথের জঠরেও নামতা পড়া শুরু হয। আড়ার উপরে টা΅ানো একটি ময়লা ধুতি, চার হাতি ঝালকাঠীর গামছা আর খরম জোড়া পায়ে গলিয়ে ¯œানের উদ্দেশ্যে পুকুর ঘাটে হাজির হন। তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন ũŝΪ বসনা সোনাই ঘাটে ¯œান সেড়ে ঘাটলায় উঠেছে। তার শরীরের সাথে লেপ্টে আছে আটপৌড়ে সাদা কাপরটি। শরীরের উচু নীচু বাঁক নেশা ধরিয়ে দেয়। হঠাৎ মাস্টার মশাইকে দেখতে পেয়ে সলজ্জ হাসে। ত্রন্ত পায়ে ভেতরের বাড়িতে পা বাড়ায়। (চলবে)
< Prev | Next > |
---|