ড. রতন কুন্ডু
(বাল্য কাল)
ড. রতন কুন্ডুচৈতালী মাঠে ভোর না হতেই যদু মাষ্টার হাক ছাড়েন---

-কালে, মেলে, আহ্লাদে, সকাল অইচে। তারাতারি উইঠা হাত মুখ ধুইয়া পাঠশালায় আসো।
যদু মাস্টার প্রবৃদ্ধ। মুখে খোচা খোচা দাড়ি, জোড়-ভুরু, চোখে পুরু লেন্সের এক পা ওয়ালা চশমা। পরণে সাদা ধুতি, গায়ে কোড়া গেঁঞ্জী, আঠালির ডালা দিয়ে দাত মাজতে মাজতে হাঁক ছাড়েন- কালে, মেলে, আহ্লাদে……

ইনি কুন্ডু বাড়ির গৃহশিক্ষক। প্রাচীন মনসা মন্দির সাফ সুতরো করে, একটি বৃন্দাবনী কেদারা, কয়েকটা ছোট চৌকি, পেতলের বাঁধানো একটি বৃন্দবনী হুক্কা আর একপাশে বাঁশের তৈরী চৌকি। তার উপরে বিছানাটা পাটি শাপটার মত গোটানো। ঘরের এক কোনে কয়েকটি হোগলার চাটাই গোল করে পাকানো। এই নিয়ে যদু মাস্টার এর সংসার। কালে, মেলে, আহ্লাদে অর্থাৎ কাঁলাচাঁদ, মিলনবালা আর আলোরানী তার ছাত্রছাত্রী। তারা একে একে হাজির হয় পাঠশালায়। হোগলার চাটাই মেলে সবাই তালপাতার খাতা, বাঁশের কঞ্চির কলম আর কাঠকয়লা দিয়ে তৈরী করা কালি নিয়ে বসে যায়। কাঁলাচাঁদ, খাড়া ক্লাসের ছাত্র আর মিলনবালা ও আলোরানী, আখাড়া ক্লাসের ছাত্রী। খাড়া ক্লাসের একটু বর্ননা দেয়া জরুরী।
তালপাতার উপরে গজাল ( বড় পেড়েক ) দিয়ে অ-আ, ক-খ লিখা আছে। মাস্টার মশাই পেছনে বসে ছাত্রের হাতসহ কলম ধরে কাচের দোয়াতের মধ্যে একবার ডুবিয়ে খাড়া পাতায় লাইনে লাইনে হাত ঘুড়ান,

-এই হইল স্বরে-অ, এই হইল স্বরে-আ এই হইল রস্সই (হ্রস্ব-ই) এই হইল দীর্ঘি (দীর্ঘ-ঈ) ইত্যাদি ইত্যাদি। আখড়া যারা লিখছে তারাও একই সাথে হাত ঘুড়িয়ে যাচ্ছে, তবে তাদের যেহেতু খাড়া (অংকিত) বর্ণমালা নাই তারা যা লিখছে দুর থেকে দেখলে তা বিমুর্ত শিল্পকর্ম বলেই মনে হবে। বলতে ভুলে গেছি যদু মাস্টার একটু নাকা। অর্থাৎ তার অধিকাংশ কথা নাক দিয়ে বের হয় বলে এক ধরণের বিচিত্র শব্দ বের হয়। আর পাড়ার বখাটে হাকিম, মহাদেব, আবদুল তাকে দেখলেই নাকি সুরে কথা বলে ভেঙ্গাত ( অনুকরণ করত ) আর মাস্টার মশাই বাঁশের কঞ্চি নিয়ে তেড়ে যেতেন।

-হালার ফালা, তোমার পিঠের চামরা তুইল্লা হালামু।
তালপাতার লেখা যখন শেষ তখন ছাত্র-ছাত্রীদের হাত, মুখ, পেট, কপাল সব জায়গায় কয়লার কালির ছোপ ছোপ চিহ্ন। মাস্টার মশাই এবার ছড়া গানের মাধ্যমে বর্ণমালা শেখাচ্ছেন-

স্বরে অ: অজগরটি আসছে তেড়ে
স্বরে আ: আমটি আমি খাব পেড়ে
রস্সই: ইদুর ছানা ভয়ে মরে
দীর্ঘি: ঈগল পাখী পাছে ধরে.....

এর পর আসে গণিতপাঠ। গণিত পাঠের কয়েকটি অংশ আছে। প্রথম অংশ - কড়া কিয়া, দ্বিতীয় অংশ- শত কিয়া এবং পরিশেষে নামতা । মাস্টার মশাই শুরু করেন

-এক কড়ার এক কড়া নামে হাতে কিছু থাকে না। ছাত্র-ছাত্রী সমস্বওে তা উচ্চারণ করে দুই কড়ার দুই কড়া নামে হাতে কিছু থাকেনা, তিন কড়ার তিন কড়া নামে হাতে কিছু থাকেনা, চার কড়ায় নামেনা হাতে এক গন্ডা। ঐ সময়ে টাকা-পয়সার হিসাব ছিল অন্যরকম। কড়ি ছিল মৌলিক মুদ্রা। ৪ টি কড়ি হলে এক গন্ডা হবে। ঠিক সেভাবে ৫ গন্ডা হলে অর্থাৎ বিশটি কড়ি হলে এক পয়সা হবে। ৪ পয়সায় এক আনা, ৪ আনায় এক সিকি, ৮ আশায় এক আধুলি ও ১৬ আনায় এক টাকা। এর সাথে মিল রেখেই ওজনের মৌলিক বাটখারা ছিল রত্তি। লাল রংএর উপর কালো দাগ ওয়ালা একটি বীজ। তার ৬ রত্তি হলে এক আনা, ১৬ আনায় এক তোলা বা এক ভরি, ৫ তোলায় এক ছটাক, ৪ ছটাক এ এক পোয়া, ৮ ছটাক এ আধা সের, ১৬ ছটাক এ এক সের আর ৪০ সের এ এক মন। এখনো মেট্টিক কিংবা ব্রিটিশ হিসাব ভারতীয়রা ( অবিভক্ত ভারত ) গ্রহণ করেনি।

যদু মাস্টার কড়াকিয়া শেষ করে শতকিরা পড়াতে মনোনিবেশ করে-

একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ, পঞ্চ বান, ছয়ে ষড় ঋতু, সাতে সমুদ্র, আষ্ট বসু, নয়ে নবগ্রহ, , দশে দিক। এর অর্থ ছাত্র ছাত্রীরা কেন অনেক অভিভাবকরাও জানতেন না। নগেন আহ্লাদীর সৎ ভাই। পাঠশালার দরজায় উকি দিয়ে মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাস করে

-মাস্টারমশাই এক চন্দ্র তো বুঝলাম কিন্তু দুয়ে পক্ষ কি?
মাস্টারমশাই এবার পেয়ে বসেন। বিজ্ঞের সাথে বলেন-

-তাইলে এক ছিলিম তামাক ভয়ে নারকেলের ছিবড়ার আগুন দিয়ে নিয়ে আসো। আমি বলছি।
অশিক্ষিত নগেন বেশীদুর পরাশুনা করেনি। বাবাকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করে। তবে পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ অনেক। কলকে নিয়ে গুরুমশাইর জন্য তামাক সাজাতে লেগে গেল। গুরু মশাই ভাবগম্ভীর হয়ে শতকিয়ার বিশ্লেষণ করছেন-
-দুই এ পক্ষ মানে অইলো শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষ। নগেন কিছু না বুঝতে পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

-বুঝলিনা হাদারাম চন্দ্রমাসে দুইটি পক্ষ থাকে । একপক্ষে আকাশে চাঁদ দেখা যায় তার জন্য তা হল শুক্ল মানে সাদা পক্ষ আর যে ১৫ দিন আকাশে চাঁদ থাকে না তাকে বলে কৃষ্ণ পক্ষ বা কালো পক্ষ। বুঝলি এইবার। নগেণ এবার দু পা এগিয়ে আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করে তিনে নেত্র কি?

-বুঝলিনা তো। নেত্র মানে চোখ। সবার দুইটা কইরা তো চক্ষু আছেই। তবে আরও একটা চক্ষু আছে। তা অইলো অন্তর চক্ষু, যা কিনা দুই ভুরুর মাঝখানে অর্থাৎ কপালে থাকে। নগেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নগেনের জ্ঞান পিপাশা দেখে বিধাবা সোনাই পিশি ঢেউটিনের বেড়ার ছিদ্র দিয়ে চোখ রাখে। দেখে যদু মাষ্টার আরাম করে তামাক টানছে আর চারে বেদ অর্থাৎ চতূর্বেদের মর্ম ব্যক্ষা করছে। সোনাই চোখ ফেরাতে পারে না। কতক্ষণ এই জ্ঞানগর্ভ কথা শুনেছে মনে নেই। হুশ হল পেছনে বৌদিও খোচায়।

-কিগোঃ বিয়ার আগেতো পড়াশুনা করলিনা এখন আবার পড়তে মন চায় নাকি? তাইলে বেড়ায় ফুটা দিয়ে কেন, সামনা সামনি গিয়া ক -মাস্টারমশাই আমারে অঙ্ক শিখান। সোনাই দৌড়ে পালায়। চোর ধরা পরলে যেমন বেকুবের মতো হাসি বের হয়। সোনাইর অবস্থাও হয়েছে তাই।
মাস্টারমশাই এবার গণিতের তৃতীয় ও শেষ পাঠ শুরু করেন

-দুই দুই অক্ষে দুই , সবাই সমস্বরে আবৃত্তি করে, দুই, দুই অক্ষে- দুই , দুই দুগুণে- চাইর, তিন দুগুণে- ছয়, চাইর দুগুণে- আট, পাঁচ দুগুণে- দশ। এই ভাবে দুই ঘরের নামতা থেকে শুরু করে দশ ঘরের নামতার শেশাব্দি দশ-দশকে একশো বলে প্রথম ব্যাচ পড়ানোর সমাপ্তি টানেন। এর পরে আসবে বয়সে অপেক্ষাকৃত বড় কিশোরদের ব্যাচ। তারা প্লেট পেন্সিল নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। (চলবে)

 

সাম্প্রতিক