স্টাফ রিপোর্টার: সরকারের নীতিগত দুর্বলতায় দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গভীর নলকূপের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একদিকে যেমন কমছে বৃষ্টির পানির প্রাপ্যতা, অন্যদিকে অপরিকল্পিত ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও আরো নিচে নেমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় বিগত ২০১৪ সাল থেকেই গভীর নলকূপ স্থাপনে নিরুৎসাহিত করে আসছে। সেজন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কৃষিজমিতে সেচের জন্য নতুন নলকূল স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে না। এমনকি পুরনোগুলো সংস্কারেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও গত তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে গভীর নলকূপের সংখ্যা ও নলকূপের সেচনির্ভর আবাদি জমির পরিমাণ। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের নিয়মনীতিতে কড়াকড়ি না থাকা, তদারকিতে শৈথিল্য এবং ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারে সরকারের নীতিগত সহায়তা না থাকর কারণেই দিন দিন গভীর নলকূপের ব্যবহার বাড়ছে। পাশাপাশি সেচনির্ভর ফসল উৎপাদনে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়া, সেচের পানির অদক্ষ ব্যবহার, ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণে জোর না দেয়া, পরিকল্পিতভাবে ফসল উৎপাদন না করা, সেচযন্ত্র স্থাপনে অপরিপক্বতার কারণেও নলকূপের মাধ্যমে সেচের ওপর নির্ভরশীলতা কমছে না। যদিও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে বিরাজ করছে ধীরগতি। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেচের পানির ৫০ শতাংশ দক্ষ ব্যবহার সম্ভব হলেও এদেশে তা হচ্ছে মাত্র ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে এখনো সেচের পানির ৬৬ শতাংশ অপচয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র জানায়, দেশে বিগত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার ৩৪। ওই বছর ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৮০৩ হেক্টর জমি গভীর নলকূপের আওতায় সেচ দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী অর্থবছরে গভীর নলকূপের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৫৬৬। ওই বছর নলকূপের আওতায় সেচ দেয়া হয় ৯ লাখ ৬২ হাজার ৩৯ হেক্টর জমিতে।
২০১৫-১৬ অর্থবছর নলকূপের সংখ্যা আরো বেড়ে ৩৬ হাজার ৯৭৯ আর সেচের আওতায় জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ১৪ হাজার ১৭৭ হেক্টরে। এক গবেষণায়ও দেখা যায় ২০১২ সালে দেশের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেয়া হয়। কিন্তু ২০১৫ সালে তা ১৬ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়। এমন পরিস্থিতিতে গত ২০ বছরে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় পানির স্তর প্রায় ১৬ সেন্টিমিটার নেমে গেছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় এক কেজি বোরো ধান উৎপাদনে গড়ে প্রয়োজন হচ্ছে আড়াই হাজার লিটারের বেশি পানি। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলে বাড়ছে সেচনির্ভর ফসলের আবাদও। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রধান ও অপ্রধান ফসলের মধ্যে সেচনির্ভর ফসল ছিল ৪৪ শতাংশ। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ঠেকেছে প্রায় ৪৮ শতাংশে। পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি ফসল আবাদেও বিরাজ করছে ভারসাম্যহীনতা।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে দেশে গভীর নলকূপ স্থাপন নিরুৎসাহিত করার ক্ষেত্রে বিএডিসি কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না মানার অভিযোগ উঠেছে। গভীর নলকূপ স্থাপন না করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা সত্ত্বেও নতুন গভীর নলকূপ স্থাপনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১৮টি স্থাপনা, ১৪৯টি গভীর নলকূপ পুনর্বাসন এবং ৬১০টি বিদ্যুৎ চালিত পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ কওে বরেন্দ্র অঞ্চলে গত কয়েক দশক ধরেই খাদ্যশস্য উৎপাদনে গভীর নলকূপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তবে পানির স্তর বেশ নিচে নেমে আসায় এখন নতুন নলকূপ স্থাপন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি সেচের জন্য পানির বিকল্প ব্যবহারে ওই অঞ্চলে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতিগত দুর্বলতার কারণেই গভীর নলকূপের ব্যবহার অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে। তাতে পানির স্তর নিচে নেমে পরিবেশে বিপর্যয় ঘটছে। এ অবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত নলকূপ স্থাপন রোধের পাশাপাশি বিতরণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি উন্নয়নের মাধ্যমে সেচের পানির দক্ষ ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। তাছাড়া বোরো আবাদের পরিবর্তে অন্যান্য ফসল আবাদেও নজর দিতে হবে। একই সাথে ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতেও কৃষকদের মধ্যে আরো সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
অন্যদিকে গভীর নলকূপ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিএডিসির চেয়ারম্যান মো. ইাসিরুজ্জামান জানান, গভীর নলকূপ কোথায় কীভাবে স্থাপন হবে, কত দূরত্বে তা স্থাপন করা হবে, সে বিষয়ের নীতিমালা মেনেই গত কয়েক দশক কাজ করছে বিএডিসি। আর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে কোথাও নতুনভাবে গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এমনকি পুরনো নলকূপগুলোকেও শতভাগ কার্যকারিতা না থাকলে মেরামতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
< Prev | Next > |
---|