স্টাফ রিপোর্টার: দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নকালে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে স্বল্পসময়ের মধ্যেই ওসব প্রকল্প স্থায়িত্ব হারাচ্ছে। যদিও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে নির্মাণ সামগ্রীর গুণগত মান তদারকির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও কর্মকর্তাদের। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। বরং নির্মাণ সামগ্রীর মান তদারকি ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে ওসব প্রকল্পে অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থাকছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে নির্মাণসামগ্রীর মান তদারকি ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র এসেছে। আইএমইডি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যথাযথ তদারকি, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট জনবলের দায়িত্বশীল আচরণের অভাব এবং সহযোগী সংস্থার যথাযথ সমন্বয় না থাকা শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নির্দেশনা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্টরা প্রকল্প পর্যবেক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। তদারকির ঘাটতিতে গতবছর উন্নয়ন প্রকল্পে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের বড় ঘটনা উদ্ঘাটন হয়। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্থলবন্দরে একটি ভবন নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করা হয়। একইভাবে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার নোয়াগ্রাম ও গাইবান্ধা সদরের মেঘডুমুর সরকারি প্রাাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজেও রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। একই ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজেও। তাছাড়া চলতি বছরের শুরুতে কুড়িগ্রামে রেলপথ সেতুর স্লিপারে লোহার পাতের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের খবর পাওয়া যায়। একই লাইনে লোহার ক্লিপের জায়গায় দেয়া হয় গাছের ডাল। ফলে ওসব উন্নয়ন প্রকল্পে ঝুঁকি বাড়ছে।
সূত্র জানায়, মেহেরপুওে গত জানুয়ারিতে নির্মাণাধীন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিঁড়ি ভেঙে পড়ে। ঢালাইয়ের মাত্র ১৫ দিনের মাথায় এমন ঘটনা ঘটে। গাংনী উপজেলার নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের শুরু থেকেই নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়। নিম্নমানের সিমেন্ট, রড, বালি ও ইট ব্যবহার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণ কাজ করে। আর অনেকটা প্রকাশ্যেই ভবন নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তার তোয়াক্কা করেনি। আবার ওই ভবন নির্মাণের কাজ তদারকিতে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান না থাকায় এমন সুযোগ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যদিও আইএমইডির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সমাপ্তি প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা যথাযথভাবে পরিপালন হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না সমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় সৃষ্ট অবকাঠামো ও সংগৃহীত যন্ত্রপাতিও। অনেক সময়ই প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর প্রয়োজনীয় জনবলের সংস্থান না থাকা অথবা নিয়োগ বিলম্বের কারণেও প্রকল্প থেকে সুফলপ্রাপ্তি বিগ্নিত হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে বাস্তবায়নকারী সংস্থার কাছে প্রকল্পের আওতায় নির্বাচিত সুফলভোগীদের সম্পর্কে আগের তথ্য যথাযথভাবে থাকে না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সুফলভোগীদের আয় কী পরিমাণ বাড়লো তা তুলনা করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকায় অধিকাংশ সময় কোনো সাইনবোর্ড থাকে না। ফলে কাজটি কোন প্রকল্প বা সংস্থার আওতায় হচ্ছে সে সংক্রান্ত তথ্যও পাওয়া যায় না। যদিও ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়সংবলিত সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাশাপাশি ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পে স্থায়ী প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়ারও নিয়ম রয়েছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত দায়িত্বের ওসব প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম সঠিকভাবে তদারক করা প্রকল্প পরিচালকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাছাড়া অভিজ্ঞতা না থাকার পরও কাউকে কাউকে প্রকল্প পরিচালক ও উপ-পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। এমনকি অনাগ্রহী ব্যক্তিদেরও অনেক সময় ওসব দায়িত্ব দেয়া হয়। মূলত প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব ও অর্থ ব্যবহারে অস্বচ্ছতাই পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে।
এদিকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান বজায় রাখতে সার্বক্ষণিক তদারকির তাগিদ দিয়েছে আইএমইডি। পাশাপাশি ৫০ কোটি বা তদূর্ধ্ব প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রকল্পে পূর্ণকালীন পরিচালক নিয়োগের কথাও বলা হয়। তাছাড়া বছরভিত্তিক এক্সটার্নাল অডিট করিয়ে তা প্রকল্প মেয়াদেই যতো দূর সম্ভব নিষ্পন্ন করার ওপরও জোর দিয়েছে আইএমইডি। এ প্রসঙ্গে আইএমইডির ভারপ্রাপ্ত সচিব মফিজুল ইসলাম জানান, সরকারি কাজ দেখভালে আইএমইডির সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ এবং যানবাহন ক্রয়ের মতো বিষয়গুলোও।
অন্যদিকে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাকাক্সিক্ষত সমস্যা সমাধানে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় বা সংস্থার নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। একই সাথে আইএমইডির সক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে।
Next > |
---|