স্টাফ রিপোর্টার : বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের। জানা গেছে, প্রতিদিনই গড়ে প্রায় আট থেকে দশজন প্রবাসী লাশ হয়ে দেশে ফিরছেন। যাদের বেশীরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এসব মৃত্যুর অধিকাংশই অস্বাভাবিক।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রাসীদের ৯০ শতাংশেরও বেশি মারা যাচ্ছেন হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং দুর্ঘটনায়। সাধারণ রোগে বা বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু খুবই কম। সরকারি হিসাবে, ২০০৫ সালে বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ২৪৮ জন। ১০ বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুন।
কেবল, ২০১৫ সালেই প্রবাসে তিন হাজার ৩০৭ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। প্রতিবছর এ সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। গত দশ বছরে মধ্যপাচ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং অন্যান্য দেশে মোট ২৮ হাজার ১৯ জন বাংলাদেশী মারা গেছেন। যাদের মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যাই ২৫ হাজার। তবে সমুদ্রপথে পাড়ি দিতে গিয়ে বা অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি জমাতে গিয়ে কতজন মারা গেছেন তার সরকারি হিসাবে বলা হয়নি।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে ১ হাজার ২৪৮ জন, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪০২, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নয় বছরে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসা ২২ হাজার ৫৬১ লাশের মধ্যে ৬১ শতাংশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে ২৯ শতাংশ (৬ হাজার ৫৮০ লাশ)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লাশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। এর সংখ্যা ৩ হাজার ৯৩৮। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২ হাজার ৭৩৪ জনের, কুয়েত থেকে ১ হাজার ৩২২, ওমান থেকে ১ হাজার ৩১৮, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮৪৫, কাতার থেকে ৬০০, বাহরাইন থেকে ৫৯৯, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৫৯৭, সিঙ্গাপুর থেকে ৪৬৫, ইতালি থেকে ৪৯৫, যুক্তরাজ্য থেকে ২৮৭ এবং লিবিয়া থেকে ১৬৪ জনের লাশ এসেছে। বাকি লাশগুলো এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে।
প্রবাসে অল্প বয়সে শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা, যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম করা, দেশে পরিবারের সদস্যদের খুশী করতে বাড়তি টাকা পাঠানোর চিন্তা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা, খাওয়া ও বাস করা এবং দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার মানসিক চাপ।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো। এই দেশগুলোতে কম মজুরিতে নির্মাণ কাজ থেকে শুরু করে, অনেক ঝুকিঁপূর্ণ কাজ করছে বাংলাদেশি শ্রমিকরা। ফলে এ দেশগুলোতে অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর হার বেশি। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছে ৫ হাজার ৩৩১ জন। যার মধ্যে হৃদরোগে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে এবং মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে। সেখানে এই তিন বছরে ২ হাজার ২৬২ বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছে।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের গত চার মাসে দেশটিতে ১৯০ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, অগ্নিকা-, আত্মহত্যা এমনকি প্রবাসে বাংলাদেশিরা খুনের ঘটনারও শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অপরাধে ৪৭টি দেশে ৭৮ জন বাংলাদেশিকে ওইসব দেশের আদালতের রায়ে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে।
পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, প্রবাসে বাংলাদেশি মৃত্যুর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব। এরপরে মালয়েশিয়া। গত কয়েক বছরে বিদেশ থেকে যত মরদেহ এসেছে তার প্রায় ৬৫ ভাগ এসেছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, ওমান ও কুয়েত থেকে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসী শ্রমিকদের মরদেহ দেশে পাঠানোর খরচ বহন করে থাকে।
এ ছাড়া ৯ হাজার ৭৫৪ জন শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণ বাবদ ওই বোর্ডের তহবিল থেকে অনুদান পেয়েছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক ধীরগতি, হয়রানিসহ নানা কারণে বেশিরভাগ শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে শ্রমিকদেও মারা যাওয়ার পেছনে মানসিক চাপ ও অশান্তি বড় কারণ।
শ্রমিকরা সর্বস্ব বিক্রি করে প্রবাসে যান অনেক বড় প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা বেশিরভাগই চরম হতাশায় পড়েন। মানবেতর জীবনযাপন করেন। নিজের দরকারেই শরীরের উপর অসহনীয় চাপ দিয়ে কাজ করতে থাকেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে পড়ে। এসবই হৃদরোগ আর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণ। এর পাশাপাশি যেসব দুর্ঘটনার কথা বলা হচ্ছে তার পেছনেও শ্রমিকদের কাজের প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের মতে, শ্রমিকদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনের জন্য একটি বাস বা ট্রাকে গাদাগাদি করে বা ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়ার মতো দেশে অহরহ ঘটছে। পরিবহনে নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অসংখ্য মৃত্যু ঘটছে বলে গবেষণায় পাওয়া গেছে। এছাড়া, যেসব তরুণ বিদেশে কাজ করতে যান তারা যাওয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে যান। তখন তাদের মেডিকেল রিপোর্ট ভাল এলেই কেবল বিদেশ যাওয়ার অনুমতি মেলে। কিন্তু বিদেশ গিয়ে স্বল্প সময়ে অসুস্থ হয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মোটেও স্বাভাবিক চোখে দেখার মতো বিষয় নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের মতে, প্রবাসে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া শ্রমিকদের লাশ দেশে আনার পর ময়নাতদন্ত করে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এতে করে মৃত্যুর সঠিক সুনির্দিষ্ট কারণগুলো চিহ্নিত হলে তা প্রতিরোধের কৌশল বের করাও সহজ হবে।
< Prev | Next > |
---|