airportস্টাফ রিপোর্টার: সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ছাড়াই দেশের বিমানবন্দরগুলোয় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রম চলছে। ফলে আন্তর্জাতিক মানের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থার (আইএটিএ) বেঁধে দেয়া মানদ- অনেক সময়ই লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ নিয়ে অভিযোগ আছে যাত্রীদের পাশাপাশি এয়ারলাইনসগুলোরও। যদিও আকাশসেবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। সব দেশেই কার্যক্রমটি পরিচালিত হয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায়। শুধুমাত্র বাংলাদেশই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তবে গত চার দশক ধরে চলা বিমানবন্দরগুলোতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস প্রোভাইডারস লাইসেন্স’ শীর্ষক নীতিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ১৯৮৩ সাল থেকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করলেও সংস্থাটির ওই নিযুক্তি নির্দিষ্ট কোনো বিধিমালার আলোকে হয়নি। পাশাপাশি দেশী কয়েকটি বেসরকারি এয়ারলাইনস বিমানবন্দরে নিজেদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে এমন অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে, যা আইএটিএ নির্দেশনার পরিপন্থী। মূলত নীতিমালার অভাবেই দেশের বিমানবন্দরগুলোর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার মান অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাতে যাত্রী দুর্ভোগের পাশাপাশি ক্ষুণœ হচ্ছে বিমানবন্দরের ভাবমূর্তিও। বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কাজের মধ্যে রয়েছে বোর্ডিং পাস ইস্যু, ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং, কার্গো লোড-আনলোড ও এয়ারক্রাফট সার্ভিসসহ বিভিন্ন কার্যক্রম। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে বিমান। তবে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিম্নমানের বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে। ওই কারণে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ লোকবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতায় বিদেশী এয়ারলাইনসগুলো দীর্ঘদিন একাধিক প্রতিষ্ঠানকে হ্যান্ডলিং এজেন্ট হিসেবে নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছে।

সূত্র জানায়, বেবিচকরে প্রণীত খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে দুই বছরের জন্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস প্রোভাইডারস লাইসেন্স দেয়া হবে। ৩ ক্যাটাগরিতে ওই লাইসেন্স দেয়া হবে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী লাইসেন্স ফি ভিন্ন হলেও সব ক্ষেত্রেই ২৫ শতাংশ হারে রয়্যালটি দিতে হবে বেবিচককে। তবে তাা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে লাইসেন্স পেলে দেশের সব বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে প্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দেয়া যাবে। ‘বি’ ক্যাটাগরির লাইসেন্সে সেবা দেয়া যাবে শুধু দেশী এয়ারলাইনসকে। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে দেশী এয়ারলাইনসগুলো নিজস্ব ফ্লাইটের প্রাউন্ড সার্ভিস করতে পারবে, যা বর্তমানেও বিদ্যমান। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ২০০ কোটি ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ৫০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিধান রাখা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। ফি ও চার্জের বিষয়ে বেবিচকের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘এ’ ক্যাটাগরিতে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য লাইসেন্স ফি ১০ কোটি ও নবায়ন ফি ৫ কোটি টাকা। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে সিলেটের ওসমানী, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য লাইসেন্স ফি ৫ কোটি ও নবায়ন ফি ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরের জন্য লাইসেন্স ফি ধরা হয়েছে ১ কোটি ও নবায়ন ফি ৫০ লাখ টাকা। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরের জন্য লাইসেন্স ফি প্রস্তাব করা হয়েছে ৫০ লাখ ও নবায়ন ফি ২৫ লাখ টাকা। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য লাইসেন্স ফি প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ কোটি ও নবায়ন ফি ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই ক্যাটাগরিতে সিলেটের ওসমানী, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য লাইসেন্স ফি ধরা হয়েছে ৩ কোটি ও নবায়ন ফি ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর সব ক্যাটাগরিতেই রয়্যালটি হিসেবে বেবিচককে ২৫ শতাংশ দিতে হবে। তাছাড়া বেবিচকের কাছে নিরাপত্তা জামানত হিসেবে জমা রাখতে হবে পরিশোধিত মূলধনের ৫ শতাংশ।

সূত্র আরো জানায়, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতার বিষয়ে খসড়া প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, দেশী প্রতিষ্ঠানকে জয়েন্ট স্টকে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত থাকতে হবে। বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ ব্যবস্থাপনা হলে ৫১ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে দেশী প্রতিষ্ঠানের। যে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুই বছর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিসের অভিজ্ঞতা থাকা প্রতিষ্ঠান ‘এ’ ক্যাটাগরিতে লাইসেন্স আবেদন করতে পারবে। তবে কোনো বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ ব্যবস্থাপনায় থাকলে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন দুটি দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিনে কমপক্ষে ৩০টি উড়োজাহাজের ন্যূনতম ৫ বছরের গ্রাউন্ড সার্ভিসের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ‘বি’ ক্যাটাগরির ক্ষেত্রেও ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিনে কমপক্ষে ২০টি উড়োজাহাজের ন্যূনতম ২ বছরের গ্রাউন্ড সার্ভিসের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হবে। নীতিমালাটি কার্যকর হলে প্রতি বছর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিরীক্ষা করবে বেবিচক। তাছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষা করে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিতে হবে। বেবিচকের অনুমতি ছাড়া কোনো যন্ত্রপাতি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। উচ্চপদে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগেও বেবিচকের অনুমতির প্রয়োজন পড়বে। সর্বোপরি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মী কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন, সংস্থা বা সংগঠন করতে পারবে না।

এদিকে রয়্যালটির বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে খসড়া নীতিমালায় বিমানের একটি পক্ষ থেকে বেশকিছু সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই প্রস্তাবনায় লাইসেন্সের মেয়াদ ২ বছরের স্থলে ৩ বছর এবং যন্ত্রপাতি ক্রয় ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগের আগে বেবিচকের অনুমতি নেয়া থেকে বিমানের অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিমানের জন্য লাইসেন্স ফি ১০ কোটির পরিবর্তে ১০ লাখ এবং নবায়ন ফি ৫ কোটির পরিবর্তে ৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি রয়্যালটি মওকুফেরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে বিমানের প্রস্তাবের বিষয়ে নীতিমালা-বিষয়ক সাব-কমিটির সদস্য বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন্স) উইং কমান্ডার চৌধুরী এম জিয়াউল কবির জানান, বেবিচকের প্রস্তাবিত নীতিমালায় সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও মূল বিষয়গুলো একই থাকবে। রয়্যালটি ফি কমিয়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশ করা হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মান বছরের পর বছর খারাপ হয়েছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে সমালোচনা ও অভিযোগের শেষ নেই। তা থেকে বেরিয়ে আসতেই নীতিমালাটি করা হচ্ছে। দেরিতে হলেও নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে যাত্রীদের পাশাপাশি এয়ারলাইনসগুলো তার সুফল পাবে।

সাম্প্রতিক