shonlaআজাদ আলম

"ওস্তোম, ওস্তোমরে, নিন গেছিস না জাগি আছিস্ রে বাউ?"

"নিন না যাওঁ বাবা। ক্যানে কি কবার চায়ছেন? কন ক্যানে?" রোস্তম ঘুমঘুম গলায় প্রশ্ন করে বাবাকে ।

"হ্যাঁরে এই মরণ দেওয়াটা যে সারেছে না রে! কোটে থাকি যে এত পানি আইসেছে? কি যে সাতাও নাগিল, কি করোঁ? মুইতো মনু কাছালোত।"
রোস্তমের বাবার গলার স্বর অজানা আশংকায় আক্রান্ত ।

"কি কইমেন্ খুলি কন ক্যানে ?" মুই তো দিশায় পাওছোঁ না কি কবার চায়ছেন। রোস্তম কাথার ভেতর থেকে মাথা বের করে কান খাড়া করে থাকে বাবার জবাবের আশায়।

"তোর নরেন কাকাক্ এনা মোবাইল করতো? বিয়ানতে মোবাইল করি কইল্, পানি নাকি কমেছে। আগিনা থাকি পানি নামি গেইছে কইল মোক্। মুই তো দেখোঁছো পানি বাড়েছে দুপুর থাকি। হামার ডাংগা পাড়ার ভিটাত্ পানি উটি উটি করেছে আর তোর নরেন কাকার বাড়িতো দোলা পাড়াত। মহা চিন্তাত পরি গেনু যে বাউ। এনা মোবাইল করি খবরটা নেতো শোংরার ঘর দুয়ার ঠিক আছে না বাড়িত্ পানি উটি গেইছে ।"

নরেন, ধীরেন আর কলীম উদ্দিন একই ক্লাসে পড়তো প্রাইমারি স্কুলে । আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারনে কলীমের পড়াশোনা বেশীদুর এগোয় নাই । বাবার সাথে ক্ষেতে খামারে দিনমজুরের কাজ হাতে নেয় দশ বছর বয়স থেকে। নরেন দুই দুইবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করলে সেও গ্রামের চৌহদ্দিতে আটকা পড়ে। ধীরেন ঠেলে ঠুলে শহব থেকে বি এ পাশ করে শহরে বিয়ে করে এবং শহরেই থেকে যায়।

" বাবা, নরেন কাকা মোবাইলযে ধরেছে না। চাজ্ বোধায় নাই"।
"ঠিক নম্বর নাগাছিস্ তো? "
কলীমের অস্থিরতা বেড়ে যায়।
"নরেনটা যে ক্যানে একেলা দোলা পাড়াত্ পড়ি থাকিল্।"

দেশ স্বাধীনের পর ভারত থেকে ফিরে আসলে ফির বছর জ্ঞাতিরা বাপ দাদার ভিটামাটি ছেড়ে যায় একের পর এক। বছর রছর কত আর বন্যার ধকল সহ্য করা যায়। বছর যায় আর বান বর্ষার যন্ত্রণা বাড়তে থাকে । নরেন যায় নি কোথাও । দুই ছেলে দূই মেয়েকে দোলা পাড়ার ছোট্ট টিলার উপরে বড় করেছে সে। তার এক কথা।" এই স্বাধীন দেশে কাহোঁ মোক বাপের ভিটা ছাড়া করির পাইবে না এক আজরাইল ছাড়া "।

"ওস্তোম শোংরার খবর ক্যাং করি নেওয়া যায় এলা ক তো। অর ব্যাটা দুইটাও তো বাড়িত্ নাই। কুত্তি বোলে কাম করির গেইছে।"

মনু কাছালোত।" মাথা চুলকাতে থাকে কলীম উদ্দিন ।
"নিন যাওতো এলা। আইত্ মেলা হইছে। দুনিয়াইর কাছাইল তোমারে মাথাত ভাংগি পরেছে। কাইল বিয়াইনোত খবর ন্যান"। কলীমের বউ মজিরন উসখুস করে।

"আইতোত বানের পানিত্ অয় ভাসি যাউক আর কাইল বিয়াইনোত শোংরার
গুয়ার গাছের গুয়া পারে আনিম আর সেই গুয়া তুই পান্ দিয়া চাবে চাবে খাইস
"বেইচ্ছা মানুষের বুদ্দি ধইচ্ছে যে কলিমুদ্দী"।

" তাইলে আমাবাইস্যার আন্ধারোত্ মাল্লীর পানি ভাংগি যাও। কায় তোমাক দড়ি দিয়া বান্ধি থুইছে? বুড়াকি বয়সোত্ বানের পানিত্ ভাসি য্যায়া মরো। কাছালোত মরিবার কায় কয়ছে তোমাক। কুটকুটা আন্ধার' তোমরাতো চোকেও দ্যাখেন কম। দেওযাটাও খালি কড্ডে পানি ঢালেছে। মরার বাইস্যা মরা । ঠসা আল্লা, কারো কান্দোন কি শুনেছে? হামাক মারেছে তো মারেছে , হাসঁ মুরগি গরু ছাগল সউক গুলাকে নাস্তানাবুদ করি ছাড়েছে। “ মজিরন সব রাগ ঝাড়ে বৃস্টি বাদল আর তার নিয়ন্ত্রকের উপর।

বউয়ের এই সমস্ত খোঁচা মারা কথায় যুক্তি খুঁজে পেলেও কলীমের অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। ঝড়,বৃষ্টি,অন্ধকার আর বানের পানি ভেংগে মাইল দেড়েক পথ যাওয়া সহজ না। সকাল হতে অনেক দেরী । তিস্তার পার ভেংগে উজানের পানি আল্লা না করুক নরেনের ভিটা হয়তঃ খেয়ে ফেলেছে এতক্ষনে । এখনই নরেনের বাড়ি যাওয়া দরকার যে করেই হউক । এই নদী ভাংগা বানের বিশ্বাস নাই।

"ওস্তোম, আর একবার মোবাইল করি দেখতো রে বাউ। না পাইলে অর বাড়ি যাবার নাগিবে। মুই এডি হওছোঁ। তুইও হাটেক মোর সোতে। দেড়ি করা যাইবে না।“

মোবাইলে নরেনের হদিস মিললো ন। মোবাইল আগের মতই নিরব।

রোস্তোমের মনটা বাবার মতই নরম, বন্ধু বৎসল। বিছানা থেকে উঠে এসে সেও রেডি। এক হাতে টর্চ লাইট আর অন্য হাতে ছাতা। দমকা বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে ছাতা। রোস্তোম বুঝলো ছাতা দিয়ে কাজ হবে না। পলিথিনে জড়িয়ে নিল মাথা এবং শরীর হাটু পর্যন্ত । কলীম ও নিজেকে একই ভাবে পলিথিনে আবৃত করলো।

রোস্তোমের মা মজিরন নিজেও স্বস্তি পাচ্ছিল না স্বামীকে কঠিন কথা গুলো বলার পর। নরেন দাদারা তো দুইদিনের পরিচিত না। বিয়ের দিন থেকেই দেখে আসছে দুই বন্ধুর হরিহর আত্নার মিল। দোলাপাড়া আর ডাংগা পাড়ার গলাগলি। গলা দইয়ের হাড়ি, গুড় চিড়া জলপান যেমন আসতো দোলাপাড়া থেকে। নতুন চালের রুটি গরম ভাপা পিঠা গামলা ভর্তি পাঠাতে ভুলতেন না মজিরনো। দুই শোংরা রাতে তিস্তায় মাছ মারতে গেলে দুই শুংরি কতদিন যে বাড়ির আংগিনায় গীত গানের আসর বসিয়েছে তার হিসেব নেই।

"মুইও যাওঁ। বাউ ওস্তোম মোকো একখান পলিথিন দে তো। কালামোক ডাকাও ক্যানে অয়োঁ যাউক। গরু বাছুর টানাটানি করির নাগে যদি"।

মজিরনের মনটাও অজানা আশংকায় কেপেঁ উঠে।
"তোমাক যাবার না নাইগবে মা। হামরা সামাল দিবার পারোমো এলা। এমনি তোমরা কাশেছেন, পানিত ভিজি নিমুনিয়া ফান্দাইমেন।“ রোস্তম মাকে নিবৃত করার বৃথা চেষ্টা করে ।

"তুই তো ট্রাংক তোষক দাগলা নিয়া উকাস পাবূ না আর শুংরির ফোতা নিয়া টানাটানি করিবে কি তোর বাপ? হাপানির উগি শোংরা নিজোক নিয়া ধইন শইন করিবে। তাইলে শুংরিক কায় ধরি এই এক কোমড় পানি পার করাইবে এলা?” মজিরনের কথার কেউ জবাব দিতে পারে না। অনিচ্ছা সত্বেও রোস্তম নিরবে সায় দেয়।

কলীম উদ্দিন নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করে। সত্য কথা গুলো যতই শক্ত ভাবে বলুক না কেন, রোস্তমের মার মনটা আসলেই দোলাপাড়ার মাটির চেয়েও নরম। নরেনদের কথা চিন্তা করে ও নিজেও স্বস্থি পাচ্ছে না।

"কালাম, কালাম তুই তাবৎ শুনিয়াও উটিছিস না ক্যানে রে? কোকরা নাগি শুতি আছিস্ যে"?
মজিরন ছোট ছেলের ঘরের কপাটে ধাক্কা দেয়।

"মোর জার নাগেছে, উটির মনায়ছে না মা। মুই যাবার পাইম না।" কালাম নাক দিয়ে সর্দি টানার শব্দ করে।

" তোর নাংসাংগের জার। কাকি যুদি দই চিড়া খাবার ডাকাইল হয়, তাইলে কথ্থোনে তারাত্ করি উটূলু হায়। তোর স্বভাব খান ক্যানে যে এই রকম টেরিয়া হইল"। মজিরনের গলায় তিরষ্কার আর অসন্তোষের স্বর।

" থাউক মা কালাম থাউক। দাগালার ভিতোরোত শুতি থাকি কলেমা দোয়া পরূক।"
রোস্তম ও রেগে যায় কালামের ভনিতায়।

" অয় দোয়া দরুদ পড়িবে? তাইলে হইছে কাম, হামরা গেইলে অয় ভঁইষের মতন নাক ডাকির ধরিবে এলা।" মজিরন তার অলস ছেলেকে ভালো করেই চিনে।

আংগিনা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এখন তিনজন। খোলা জায়গায় বাতাসের বেগের প্রচন্ডতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রোস্তোমের মা।

" আউন্দি বাতাস যে মোক উরি নিগায়ছেরে বাউ। মরার দেওয়ার পানিও কমেছে না। বিজলীও চমকায়ছে। মোর হাতখান ধত্তোরে বাউ ।

মায়ের হাত ধরতে গিয়ে আচঁলে হাত পরে যায় রোস্তোমের ।
" কোচাত্ এগুলা আবার কি নিচিস মা?"

নোহায় কোনো? তুই হাটেক তো?

"গুড় গুড়ি পিটা নিছে বোধায় । চুলাত্ পুড়ি পুড়ি শুংরিক খাওয়াইবে এই সাতাওত"। শুংরির জন্য জিউখান ব্যারে যায়ছে"। কলিমুদ্দী খোঁচা মারার সুযোগ পায়।

" নিচু তা কি হইছে? খালি খালি ফ্যাদলা পারি মনায়ছে না? বানোত মানসি গুলা বন্দি হয়া আছে। খাইল কি না খাইল, তার চিন্তা কইরছেন কয়বার?”

কলিমুদ্দী আর কথা বাড়ায় না। ঝাউলীর জংগল পার হয়ে বামদিক দিয়ে দোলাপাড়া যাওয়ার কাচা রাস্তা । রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিস্তার বাধ ভাংগা বানের পানি । বুকটা ধক করে উঠে কলিমুদ্দীর। নরেন শোংরার ঘর দুয়ার ঠিক আছে তো! আর মানুষ গুলা!

রোস্তম টর্চ মারে সামনে। রাস্তার কোন চিনহ চোখে পরছে না। মজিরনের বুকটা কেপে উঠলো । এতো দেখি ফুলছেরাত পার হওয়ার মতো কঠিন ব্যাপার ।

"খিব সাবধানে হাটির নাইগবে কিন্তু । পিছলে গেইলে ভাসি যাইমেন। আল্লার নাম নিয়া নামি পরো। "
"বাবা মুই আগোত থাঁকো আর মদ্দোত মাও মোর কমড় খিচি ধরুক আর তোমরা পিছোনোত থাকি মাক সামলাইবেন মাও যাতে ফসকি না যায়"।

রাস্তার উপর পানি কোমর ছোয় ছোয়। রোস্তম দক্ষ নাবিকের মত বেশ সতর্কতার সাথে পা ফেলছে আর কোন গর্ত টের পেলে বাবা আর মাকে সাবধান করে দিচ্ছে আগে ভাগেই।
আধা মাইল রাস্তার মাথায় নরেন দের বাড়ি । টর্চের আলোয় আশপাশে পানি আর পানি ছাড়া কিছু চোখে পরছে না। বিজলীর চমকানিতে থৈ থৈ বানের পানি দেখা দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকারে ।বাতাসের শনশনানি বাড়ছেই। কলিমুদ্দীর মাথায় একটাই আশংকা শোংরার বাড়ি ঘর আর মানুষ দুইটা ঠিক ঠাক আছে তো!

মাঝপথে যেতে না যেতেই কলিমুদ্দী হাক দিল " শোংরা, নরেন শোংরা মুই কলিমুদ্দী, শুনির পায়ছেন?

" হাকাউ চিল্লান্ না তো? ঘর বাড়ি গুয়ার গাছ কিছুই দ্যাখা যায়ছে না, এলাইতেই বুক ফাটি ডাকেছেন। আল্লা আল্লা করো ঘাটাগোনা আগোত্ পার হই।" মজিরন কলিমুদ্দীর মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পারছে না।
"মা, মোক শক্ত করি ধরেন আউন্দি তুফান খান বাড়েছে বোধায় । আর বেশী দুর নাই আসি গেছি, ঐ যে কাকার ঘরের চালা দেখা যায়ছে”।
,
কাকা ও মুই ওস্তোম, বাড়িত্ আছেন?"

"শোংরা মুই কলিমুদ্দী, শুনির পায়ছেন শোংরার ঘর"?

হাউ মাউ কান্নার শব্দ ভেসে আসলো নরেনের ডুবন্ত ভিটা থেকে । নরেন যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউএর মরণ ছোবল থেকে রেহাই পেয়ে নতুন করে জীবনের স্বাদ পেল। শোংরা দেবদূত হয়ে এসে পড়েছে উদ্ধার করতে। গলার স্বর কান্নায় জড়িয়ে গেলেও মনের মধ্যে আশার অবারিত আলো ঢেউ খেলছে।
" কায় বাহে হামার ওস্তোম বাউ আও কারেছেন না কি ?। হামার কলিমুদ্দী শোংরা? মোর কইলজাখানোত পানি আসিল্ রে বাসন্তী । নারায়ণ হামাক বাচেবার তুকুন ফেরেশতা প্যাটে দিছে রে। মোর মনটা ঠিকে কচ্ছিল, কাছুয়া কালের থাকি অয় মোর শোংরা,ওমরা না আসি কি বসি থাকির পারে রে বাসন্তী ?”

সাম্প্রতিক