sdgf21মাহমুদুল বাসার

গত ৩/৫/১৭ তারিখের দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে অ্যামনেস্টির অভিযোগ। তারা বলেছে, ‘স্বাধীন মত প্রকাশের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার বাক স্বাধীনতা খর্ব করতে খড়গ হস্ত।’ আরো অভিযোগের ফিরিস্তি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এই সংগঠনটি। তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, ‘বাংলাদেশে রুদ্ধ, বিরুদ্ধ মত।’
ভেতরে আরো অনেক অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে অ্যামনেস্টি। এর আগে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও এই সংগঠনটি অভিযোগ তুলেছিলো। তা নিয়ে যথেষ্ঠ তোলপাড় হয়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধ মত যদি রুদ্ধই হবে তাহলে অ্যামনেস্টির এতবড় অভিযোগের ফিরিস্তি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ছাপা হলো কীভাবে?

বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো অনায়াসে, নির্ভয়ে টকশো প্রচার করে যাচ্ছে। এবং সে টকশোতে অধিকাংশ সময় সরকারের কঠোর সমালোচনা হয়ে থাকে।
যে দিন অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, সেদিনই খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার হুমকি। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামীলীগের পালাবার সময় হয়েছে।’ তিনি গত প্রায় ৭/৮ বছর ধরে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পালাবার হুমকি দিয়ে আসছেন তিনি। আওয়ামীলীগ সরকার কখনো তার প্রতিবাদ করেছে, কখনো খালেদা জিয়ার এসব কথা গায়ে মাখেনি। এ্যড়িয়ে গেছে। এটা কি ‘রুদ্ধ বিরুদ্ধ মত’?

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামগ্রিক দৃষ্টিতে, গঠনমূলক ভঙ্গিতে, প্রকৃত সত্যের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে নয়, বিচ্ছিন্ন, পরম্পরাহীন কৌশলে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি। বাংলাদেশে এখন অগণিত পত্রিকা, অগনিত টিভি চ্যানেল। প্রায় প্রতি সপ্তায় আমরা পত্রিকায় পাচ্ছি বিবিসির কঠোর বিশ্লেষণ। তাছাড়া অনেক বড় বড় ও ওজনদার তাত্ত্বিক, এক সময়ের জাসদের মতো উস্কানী মূলক ভাষায়ও সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মত প্রকাশের পথ কখনো রুদ্ধ করা হয়নি।
এক সময় ব্লগাররাই গণ জাগরণ মঞ্চ গঠন করেছিলো। গণজাগরণ মঞ্চের দাবিকে ভিত্তি করেই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তখন কিন্তু অ্যামনেস্টি গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ নেয় নি, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছিলো। বলেছিলো যে, এ বিচার আন্তর্জাতিক মান সম্মত হচ্ছে না, আইনের সঠিক ধারায় এ বিচার হচ্ছে না। আবার এখন অ্যামনেস্টি ব্লগারদের পক্ষ অবলম্বন করে কথা বলছে। আমরা বরাবর লক্ষ্য করে আসছি অ্যামনেস্টি এই সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। অ্যামনেস্টির লক্ষ্য বর্তমান সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের আস্কারা দেয়াই হচ্ছে তাদের মূল লক্ষ্য।
আমরা টিভি খুলেইতো সরকারের সমালোচনা শুনছি। অষ্ট প্রহর আমরা বিএনপির হুমকির ভাষা শুনছি। আদালত প্রাঙ্গনে গ্রীক ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজত সহ ইসলামী দলগুলোর উগ্র মূর্তি টিভিতে দেখানো হয়েছে, পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে তাদের কঠোর হুমকির ভাষা। সরকার তাদের কণ্ঠরোধ করতে যায় নি। সরকারের নিজস্ব পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে ঈদগাহর- নিকটবর্তী জায়গায় গ্রীক মহিলার ভাস্কর্য দাঁড় করোনো ঠিক হয় নি। তাই খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করেছেন ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিতে। এও মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে বর্তমান হাইকোর্টেও প্রধান বিচারপতি পাবলিকলি তার নিজস্ব স্বাধীন মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছেন, যা আগের কোনো সরকারের আমলে ঘটেনি। জনপ্রিয় কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে সমর্থন করেছেন, আইন মন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। মাঝে মাঝেই দেখি, উগ্র মৌলবাদী দল চরমোনাই সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর হুমকি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে। কখন সরকার তাদের কণ্ঠরোধ করতে গেলো?
বর্তমান বাংলাদেশের শতাধিক পত্রিকা প্রতিদিন সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করছে, তার নব্বই ভাগ বর্তমান সরকারের সামালোচনা মূলক। সরকারি দলের কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা মন্ত্রী, এমপির কোনো দোষ পেলে পিঠের চামড়া তুলে দেয়া হচ্ছে গণমাধ্যমে। রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে, তার খবর আমরা ঠিকমতই গণমাধ্যমে পাচ্ছি। গাইবান্ধার সাঁতালদের ঘটনায় গণমাধ্যম বেপরোয়া ভূমিকা নিয়েছে। সরকারি দলের লোকদের যতটা অপরাধ ছিলো তার চুল পরিমাণও গোপন করে, আড়াল করে, কম দেখিয়ে গণমাধ্যম সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, সরকারি দলের দু’জন এম পি-কে জেল খাটানো হয়েছে। সাবেক রেল মন্ত্রী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে সরকার ডিফেন্স দিতে যায় নি। গণমাধ্যম তাকে তুলোধুনো করতে একটুও কসুর করেনি।
হেফাজতের সঙ্গে নাকি সরকারের আপোস হয়েছে, এই প্রসঙ্গ ধরে গণমাধ্যম সরকারের যে সমালোচনা করেছে তার ভাষা মোলায়েম ছিলো না। সরকার এ ব্যাপারে কোনো অসহিষ্ণুতা দেখায়নি।
প্রধানমন্ত্রী কওমী শিক্ষাকে স্বীকৃত দেবার পক্ষে এবং গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে সহিষ্ণু ভাষায় যুক্তি দিয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি সব সময় ডিফেন্সিভ অফেন্সিভ নন।
রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক গোরা বলেছেন, আমি কোনো ধর্মের অবতার নই, কিন্তু দেশের ভক্তিকে আমি ভক্তি করি। শেখ হাসিনাও দেশের ধর্মকে শ্রদ্ধা করেন। ব্লগার তরূণদের ড. জাফর ইকবাল পর্যন্ত বলেছেন, ধর্ম নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য ব্লগে লিখো না। সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ধর্মকে কটাক্ষ করে লেখাকে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। শেখ হাসিনা বার বার তীক্ষ্ম, স্পষ্ট কন্ঠে বলেছেন, ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ধর্ম নয়, ইসলামও নয়।’ সেক্ষেত্রে ব্লগে কেউ ধর্ম নিয়ে কন্ট্রোভার্সিয়াল বক্তব্য দিলে সরকারকে সংবিধান সম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাকে কন্ঠরোধ বলা চলে না। তিনি তার দলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে ক্ষমা করতে পারেন নি। সার্বোচ্চ সহনশীলতার সঙ্গে শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনা করছেন। দেশের গণমাধ্যম নেতিবাচক তথ্যই প্রকাশ করছে শতকরা ৯০ ভাগ। তারপরও সরকার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, আপন গতিতে দেশের উন্নতি করে যাচ্ছে। দেশের হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা হয়েছে তার ব্যাপারেও সরকারকে দোষারোপ করে খবর বেরিয়েছে। ত্রাণ পাঠানো হয়েছে হাওর অঞ্চলে, ত্রাণমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী গিয়েছেন দুর্গত এলাকায়, তবুও ইতিবাচক কোনো বিশ্লেষণ নেই, বক্তব্য প্রকাশ পায় নেতিবাচক। ত্রাণ পাওয়ার কোনো খবর ছাপা হয় না, খবর ছাপা হয় না পাওয়ার। ১০ টাকা কেজির চাউল কি কেউ পাননি? না পাওয়ার খবর প্রকান্ড করে ছাপা হয়েছে। তার পরও সরকার কার কন্ঠ রোধ করতে গেলো? সুজনের কন্ঠ আগাগোড়া সোচ্চার সরকারের বিরেুদ্ধে। অন্তত আমার চোখে পড়েনি সুজন সরকারের একটা মাত্র কাজেরও প্রশংসা করেছে। তাহলে গণমাধ্যমের কন্ঠ রুদ্ধ হলো কী ভাবে? অ্যামনেস্টির একপেশে বক্তব্যের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ হওয়া উচিত।

মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।

সাম্প্রতিক