বেলাল হোসেন ঢালী । ০২ মে ২০১৭
বেলাল হোসেন ঢালীদরজা খুলে একমুঠো গোলাপ হাতে বাবলুকে দেখে জয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! জয়া কি দিনে-দুপুরে স্বপ্ন দেখছে নাকি কল্পনা। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা নয়! বিয়ের পর জয়ার ভুলেও যার কথা একবার মনে হয়নি, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বা কল্পনা করা কী করে হয়! আবার বাস্তবটাও কী করে সম্ভব। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ৭০০০ কিলোমিটার দূরে অস্ট্রেলিয়ায় কোনো ধরনের যোগাযোগ, ঠিকানা, ফোন নম্বর ছাড়াই কী করে বাবলু সরাসরি আমার বাসায় এসে হাজির! কিন্তু কেন? বাবলু কি আমার সুখের সংসারে...জয়া ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়।

জয়া সবুজের স্ত্রী। ভালোবাসা নয়, অ্যারেঞ্জ ম্যারিজ। দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয় সবুজ ও জয়ার। তবে বিয়েটা হুট করেই হয়ে যায়। কারণ, সবুজ জয়াকে দেখে তার মা-বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে যে এই মেয়েকেই সে চায়। জয়ার ফ্যামিলিও সবুজের মতো উপযুক্ত পাত্র হাতছাড়া করতে চায় না।

সবুজ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন প্রবাসী। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা শেষ করার সাথে সাথে চাকরি পেয়ে গেলেও পারমানেন্ট রেসিডেন্সির জন্য অপেক্ষা করতে করতে সবুজের বিয়ের বয়সটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। ছেলেদের বিয়ের জন্য ৩৫ বছর তেমন একটা বেশি নয়, বাট মেয়ে যদি হয় বিশ কি বাইশ, তাহলে একটু-আধটু সমস্যা তো দেখা দিতেই পারে। কিন্তু না, সবুজ আর জয়ার মাঝে বয়স নিয়ে কখনো কোনো সমস্যা দেখা যায়নি।

জয়া অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে এক বছর হতে চলল। সবুজ সকাল ৭টায় উঠে অফিসে চলে যায়। বাসায় ফেরে রাত ৭-৮টায়। সবুজ অফিস থেকে এলে জয়া ঠিক খাঁটি বাঙালি বধূর মতো তাকে সেবাযত্ন করে, যেটা সচরাচর আজ-কালকার মেয়েরা করে না। একদিন রাতে ডিনার সেরে ওরা দুজন সোফায় শুয়ে টিভি দেখছে। জয়া সবুজের বুকের মাঝে মাথা রেখে শুয়ে আছে। জয়া নিজেই সবুজকে বলল-
এই শুনছ, আমাকে একটা জব খুঁজে দাও না। সারা দিন বাসায় একা একা ভালো লাগে না। তুমি কাজ করবে? কেন, কোনো সমস্যা? না, সমস্যা নয়। তবে... তবে কী? একা একা এভাবে সারা দিন বাসায় কার ভালো লাগে বলো? একটা কাজ পেলে আমার সময়টা কাটল, এক্সট্রা কিছু ইনকামও হলো। আই নো দ্যাটস। কিন্তু তোমার কষ্ট হোক, সেটা আমি চাই না। আমার তো বাসায় একা একা বড় কষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা তো করছি তোমার একটা খেলার পুতুল নিয়ে আসতে। দেখো, এত সকালে আমি সেটা চাই না। আগে লাইফটাকে একটু এনজয় করি। বাচ্চা থাকলে কি এনজয় করা যায় না? যায়, কিন্তু এই যে এখন যেভাবে চাও, সেভাবেই আমাকে পাও। তখন কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। ভালোবাসাটা তখন দুভাগ হয়ে যাবে। সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো ভাগ হয় না। এক ডজন সন্তান এলেও না। এ কথা বলেই সবুজ জয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে। জয়া প্রথমে বাধা দিলেও দ্রুত সবুজের স্পর্শ জয়ার শরীরে আনন্দের অনুভূতি শিহরিয়ে ওঠে। ওরা দুজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ভালোবাসার আদিম খেলায় মেতে ওঠে।

দুই বছরের মাথায় জয়ার কোলজুড়ে এক রাজকুমার আসে। ওরা ছেলের নাম রাখে জয়। ছেলে হওয়ায় সবুজ খুব খুশি। জয়ার প্রতি সবুজের ভালোবাসা আরো বেড়ে যায়। সংসারের সব কাজ পারলে সবুজ একাই করে দেয়। পাশাপাশি, ছেলেকে পেয়ে জয়া যেন স্বামীকে ভুলেই যেতে বসেছে। সারা দিন ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ বা কষ্ট নেই সবুজের মনে। সবুজ এখন সপ্তায় এক দিন জয়াকে কাছে পেলেই হ্যাপি।

দেশে থাকতে জয়ার নিজস্ব কোনো ফেসবুক আইডি ছিল না। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর সবুজই জয়াকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দেয়। একটা ছেলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট বেশ কিছুদিন ধরে জয়ার ইনবক্সে ঘুরপাক খাচ্ছে। জয়া দেখেও একসেপ্ট করে না। জয়া জানে, একটা কেন দশটা ছেলে ফ্রেন্ড থাকলেও তার স্বামী কিছু মনে করবে না। কারণ, সবুজ সে ধরনের ছেলে নয়। তার পরও জয়া এই ছেলেটাকে ফ্রেন্ড লিস্টে আনতে চায় না। কারণ, ছেলেটাকে জয়া ভালো করেই চেনে।

অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর দু-একটা ক্লোজড ফ্রেন্ড ছাড়া কারো সাথেই জয়ার যোগাযোগ নেই। ছেলে হওয়ার পর জয়া ওদের সাথেও ফেসবুক চ্যাটে যাওয়ার সময় পায় না। বান্ধবীরা ভাবে, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে জয়ার দেমাগ বেড়ে গেছে। তাই তারাও খুব বেশি একটা জয়াকে নক করে না। একদিন ফেসবুকে একটা মেয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখে জয়া খুশিতে আঁতকে ওঠে। জয়ার ক্লাসমেট মিতু। তাড়াতাড়ি একসেপ্ট করেই একটা মেসেজ দিল- আমার কথা তোর মনে আছে?
সাথে সাথে রিপ্লাই এল। আমার ঠিকই মনে আছে। তুই তো বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলি আমাদের জানালিও না। তাই ভাবছিলাম, তোর সাথে সাইধা সাইধা যোগাযোগ করব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না। আসলে হটাত করেই সবকিছু...আর এখানে আসার পর এত ব্যস্ত হয়ে গেছি যে...।
ওরা দুজন বেশ লম্বা সময় ধরে চ্যাট করে। এরপর জয়া আর মিতুর সাথে প্রায় প্রতিদিন ফেসবুকের মেসেঞ্জারে চ্যাট হতো।

বাবলু বলল- কী ভাবছ? না চেনার ভান করে দরজা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় কি না? বাবলুর কথায় জয়ার তন্দ্রা ফিরে এল। জয়া দরজা থেকে সরে দাড়ালে বাবলু ভেতরে ঢুকেই- ‘কনগ্র্যাচুলেশনস ফর ম্যারিজ অ্যান্ড বেবি বয়’ বলে ফুলের গোছাটা জয়ার দিকে এগিয়ে দিল। জয়া বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। হাত থেকে ফুলের গোছাটা নিয়ে পাশেই রাখল। তোমার ছেলে জয় কোথায়? জয়া বাবলুর কথা ও আচরণে খুবই অবাক হচ্ছে! আনমনে ভাবে-বাবলু আমার ছেলের কথাও জানে! কিন্তু কীভাবে! বাবলু লাউঞ্জের চারদিকে তাকিয়ে সোফায় বসে। আমি বুঝতে পারছি আমার এভাবে আসাটা তুমি আশা করোনি। বুঝতে যদি পেরেছ তাহলে এলে কেন? এর জন্য তুমিই দায়ী। মানে? আমি তোমাকে ফেসবুকে বেশ কয়েকবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম, বাট তুমি আমাকে একসেপ্ট করোনি। তুমি ভেবেছ ফেসবুকে একসেপ্ট না করলে আমি আর তোমাকে খুঁজে পাব না। তুমি কবে কখন অস্ট্রেলিয়ায় এলে আর কী করেই বা আমার বাসার ঠিকানা... । ভালোবাসা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। ভালোবাসা! ভালোবাসার মানুষটির সাথে মনে হয় বিয়ে না হওয়াই ভালো। বিয়ে হলে মানুষটা থাকে, ভালোবাসা থাকে না। আর যদি বিয়ে না হয়, তখন মানুষটা থাকে না, তবে ভালোবাসা থেকে যায়। অ্যানি ওয়ে, উঠি...বলেই উঠে দাঁড়ায় বাবলু। কেন? তোমার হ্যাজব্যান্ড এসে দেখে ফেললে তোমার সংসারে অশান্তি হোক সেটা আমি চাই না। সেটা যদি না চাইতে তাহলে এভাবে না জানিয়ে আসতে না। ওকে, এর পর থেকে জানিয়ে আসব। আসি। সেকি! কিছু না খেয়ে এভাবে...
জয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় বাবলু। বাবলুর এভাবে আসা এবং তার কথাগুলো জয়াকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

বাবলু ও জয়া একই কলেজে একই ক্লাসে পড়ত। বাবলু সব সময় জয়ার দিকে খুব দুষ্টু চোখে শিকারি পাখির মতো তাকিয়ে থাকত। বাবলুর চাহনিতে কেমন যেন জাদু আছে। ওকে দেখলেই জয়ার ভেতরটা কেমন জানি ওলট-পালট হয়ে যেত। মনে হতো, এই বুঝি বাবলু সবার সামনে জয়ার হাত ধরে বলে বসবে, ‘আই লাভ ইউ।’ কিন্তু না, বাবলু সেটা করেনি। একবার জয়ার বইয়ের ভেতর একটা চিরকুট রেখেছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘আই লাভ ইউ খুব সস্তা একটা ডায়ালগ। আর সবার মতো এই সস্তা ডায়ালগ দিয়ে আমি তোমাকে প্রেম নিবেদন করব না। সময়-সুযোগ হলে ইংলিশ ছবির নায়কের মতো সবার সামনে তোমার রাঙা ঠোঁটে আদর দিয়ে জানিয়ে দেব আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।’ জয়া সেটা পেয়ে না পাওয়ার ভান করে কাটিয়ে দিয়েছে এবং ভয়ে বাবলুর কাছ থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকত। কিন্তু মনে মনে জয়া বাবলুকে খুব পছন্দ করলেও মা-বাবা কিংবা সমাজের ভয়ে সেটাকে নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। বিয়ের পর একবারের জন্যও জয়ার বাবলুর কথা মনে হয়নি। কিন্তু আজ বাবলু এভাবে এসে জয়ার ভেতরটা কেমন ওলট-পালট করে দিয়ে গেছে। জয়া সংসারের কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না। সারাক্ষণ নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করেও কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। কেন বাবলু এভাবে এল আর এভাবে চলে গেল! এসব কি বাবলুর নিছক পাগলামি? নাকি...
সবুজ অফিস থেকে এসেই ছেলের সেবাযত্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেকে কোলে নিয়ে সবুজ সোফায় বসতেই চোখ পড়ে টি-টেবিলের ওপর রাখা গোলাপগুলোর দিকে। বাবলুর আনা গোলাপগুলো জয়া প্রথমে ফেলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু অজানা কোনো শক্তি ওর মনটাকে টেনে ধরে। জয়া বাবলুর গোলাপগুলো টি-টেবিলে খুব সুন্দর করে একটা ক্রিস্টালের টপে সাজিয়ে রাখে। সবুজ -এত সুন্দর গোলাপগুলো কোথায় পেলে? একটু শপিংয়ে গিয়েছিলাম। ফুলগুলো দেখে খুব ভালো লাগল, তাই নিয়ে এলাম। আমি ভাবলাম, কেউ আবার তোমাকে গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন করল কি না। থ্যাংকস গড, সেটা হয়নি। জয়ার গলা শুকিয়ে আসছিল। জয়া ছেলের দুধ বানানোর কথা বলে সরে গেল। এই একটা মিথ্যার জন্য জয়া সারা রাত ঘুমোতে পারেনি।

পরদিন সকাল ঠিক ১০টায় জয়ার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। জয়া দৌড়ে এসে ফোন রিসিভ করে। প্রতিদিন প্রায় এ সময় সবুজ অফিস থেকে জয়াকে ফোন করে। কিন্তু না, আজকের ফোনটা সবুজের না। ‘হ্যালো’ বলতেই অপর প্রান্ত থেকে-কেমন আছো? ও তুমি! কাকে এক্সপেক্ট করেছিলে? অন্তত তোমাকে না। জানি। তুমি দেখি সবই জানো! শুধু তোমাকে জানতে পারিনি। মানে কী? যদি জানতাম, তাহলে তোমাকে অস্ট্রেলিয়ায় আসতে দিতাম না। তোমার মাথা কি ঠিক আছে? মাথা ঠিক থাকলে কেউ তার বিবাহিত প্রেমিকার জন্য সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসে? মানে? বলেছি তো, ‘আই লাভ ইউ’ এই সস্তা ডায়ালগ দিয়ে আমি আমার প্রেম নিবেদন করব না। বাবলু, আমি বিবাহিত। আমার স্বামী আছে, সন্তান আছে। বোকার মতো কথা বলবে না। তোমার স্বামী আছে, সন্তান আছে কিন্তু বয়ফ্রেন্ড তো নেই। ছি বাবলু, সরি, আমি রাখি। জয়া ফোন রেখে দেয়।
এরপর প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও বাবলু আর ফোন করেনি। জয়া বাবলুকে বিন্দুমাত্র ভালো না বাসলেও তার মন থেকে বাবলুকে এক সেকেন্ডের জন্য সরাতে পারছে না। মনে মনে ভাবে, ফোন রেখে দিয়ে সে কি বাবলুকে অপমান করল? আবার ভাবে, ঠিকই করেছে। এসব পাগলামির কোনো মানে হয়! কিন্তু জয়া নিজেই জানে না, কেন জানি সে বাবলুর ফোনের অপেক্ষায় থাকে। জয়া নিজেকেই প্রশ্ন করে তার এমন হচ্ছে কেন? এসবের মানে কী? তার মানে জয়ার ভেতরে কি বাবলুর জন্য ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল? এক সপ্তাহ ধরে জয়া ফেসবুকও দেখে না। এক সপ্তাহ পর আজ প্রথম লগঅন করতেই দেখল মিতুর কয়েকটি মেসেজ- কী ব্যাপার জয়া, ফেসবুকে আসছিস না কেন? তোর শরীর ভালো তো ইত্যাদি ইত্যাদি।

জয়া উত্তর লিখেছে- আমি ভালো আছি, বাট...
সাথে সাথেই রিপ্লাই এল- বাট কী? অ্যানি প্রোবলেম? না, কিছু না। এমনিই। তুই না বললেও আমি জানি। কী জানিস? বাবলু, বাবলু তোর শান্ত মনটাকে অশান্ত করে তুলেছে। আশ্চর্য! তুই- বাবলুর সাথে আমার ফেসবুকে যোগাযোগ আছে। আমার কথা কিছু বলে? ও তো অস্ট্রেলিয়ায় গেছেই তোর জন্য। এসবের কোনো মানে হয়, বল! আমি বিবাহিত, তা ছাড়া... আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, বাট... ও আমার কাছে কী চায়? একটা ছেলে একটা মেয়ের কাছে কী চায়? এটা কি সম্ভব? আমি বিবাহিত, আমার... ও কিন্তু একটু পাগল টাইপের। এমন কিছু করিস না যাতে তোর সংসারে ঝামেলা বাধিয়ে দেয়। বাসায় ডেকে ভালোভাবে বুঝিয়ে ম্যানেজ করিস। বুঝিস তো, এ বয়সে ছেলেদের ভালোবাসা নাকি কোনো বাধা মানে না।

জয়া মিতুর কাছ থেকে বিদায় নিতেই বাবলুর ফোন বেজে ওঠে। অনেকক্ষণ ধরে রিং হচ্ছে। জয়া রিসিভ করবে কি করবে না, তা ভাবতে ভাবতেই ফোন কেটে যায়। আবারো রিং। জয়া এবার ফোনটা রিসিভ করে। অবশেষে দয়া হলো তাহলে। বাবলু, শোনো... আমি জানি, তুমি কী বলবে। এক কথা বারবার ভালো লাগে না। একটু ভালোবাসার কথা বলো। বাবলু... আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, আমি তোমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করব না। তুমি স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে আছো, সুখে থাকবে। শুধু আমার ভালোবাসাকে অপমাণিত কোরো না। তাহলে আমি বাঁচব না। জয়া তার ভাষা হারিয়ে ফেলে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। আচ্ছা আমি রাখি। ভালো থেকো। গুড নাইট।

এরপর প্রায় প্রতিদিনই বাবলুর সাথে জয়ার ফোনে কথা হয়। বাবলু কথার ফুলঝুরি দিয়ে জয়াকে ভালোবাসার নতুন স্বপ্নের জগতে বিচরণ করায়। জয়া শুধু চুপ করে শোনে। মনে মনে ভাবে, বাবলু জয়াকে এতটা ভালোবাসে এটা যদি জয়া বিয়ের আগে বুঝত, তাহলে জয়া কিছুতেই সবুজের সাথে বিয়েতে রাজি হতো না। প্রথম প্রথম বাবলুকে জয়ার অসহ্য লাগলেও এখন কেন জানি জয়ার বাবলুর কথাগুলো খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন জয়া বাবলুর ফোনের অপেক্ষায় থাকে। বাবলুকে নিয়ে সবুজের সাথে জয়ার যাতে ভুল-বোঝাবুঝি না হয়, সে জন্য জয়া সিদ্ধান্ত নেয় বাবলুকে একদিন বাসায় দাওয়াত করে সবুজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। জয়া একটু ভয়ে ভয়ে ছিল সবুজ ব্যাপারটা কীভাবে নেয়। কিন্তু না, সবুজ এতে খুবই উত্সাহ দেখায় এবং বাবলুকে খুব ভালোভাবে আপ্যায়ন করে। রাত দশটা অবধি বাবলুর সাথে গল্প করে সবুজ নিজেই তাকে তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসে।

এর পর থেকে বাবলু ওদের ফ্যামিলি মেম্বারের মতো হয়ে যায়। যখন-তখন যেকোনো প্রয়োজনে বাসায় আসে এবং জয়া ও সবুজ তাদের যেকোনো অকেশনে বাবলুকে ইনভাইট করতে ভোলে না। কোথাও একসাথে বেড়াতে গেলে বাবলু ওদের ছেলে জয়ের খেলার সাথি হয়। সবুজ লক্ষ করছে, বাবলুকে পেয়ে জয়ার একাকিত্ব অনেকটা দূর হয়েছে এবং জয়া আগের থেকে অনেক চঞ্চল, উদ্দাম ও হ্যাপি। সবুজও অনেকটা চিন্তামুক্ত। স্ত্রীর সুখে কে না সুখী।
বাংলাদেশ থেকে ফোন আসে, সবুজের মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাড়াহুড়ো করে সবুজ বাংলাদেশে চলে যায়।
এক উয়িকেন্ডে বাবলু জয়া আর জয়কে নিয়ে সারা দিন ঘুরেফিরে রাতের ডিনার বাইরে সেরে রাত ৯টার দিকে বাসায় ফেরে। সারা দিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে জয়ার ছেলে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে। জয়ার বাসায় ঢুকে বাবলু সোফায় হাত-পা এলিয়ে বসে পড়ে। জয়া রুমে গিয়ে ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নাইটি পরে লাউঞ্জে এসে বাবলুর পাশে বসে। সবুজ রঙের সিল্কের নাইটিতে জয়াকে অনেক সুন্দর লাগছিল। এত সুন্দর জয়াকে এর আগে কখনো দেখেনি বাবলু। বাবলু জয়ার দিকে পলকহীন চোখে শিকারি পাখির মতো তাকিয়ে থাকে। সেই কলেজজীবনে বাবলু যখন এভাবে তাকাত, জয়ার ভেতরে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যেত। বাবলুর চোখে চোখ পড়তেই জয়া বুঝতে পারল নাইটি পরে বাবলুর সামনে আসা ঠিক হয়নি। জয়া উঠে দাঁড়াতেই বাবলু জয়ার হাত ধরে ফেলে। একটা হেঁচকা টান দিয়ে জয়াকে কোলের মধ্যে নিয়ে আসে। দুই হাতে জয়াকে বুকের ভেতর চেপে ধরে জয়ার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে জোর করে আদর করে। জয়া অনেক চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিয়ে রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। জয়ার বুকের ভেতর ভূমিকম্প হচ্ছে। শরীরের লোমকূপগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। শরীরজুড়ে কোনো এক ভিন্নতর অনুভূতি শিহরিত হচ্ছে। সবুজের স্পর্শে তো কোনো দিন জয়ার এ রকম লাগেনি। আজ জয়ার এ রকম লাগছে কেন? জয়া আয়নার ভেতর দেখতে পায় বাবলু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কামনার লোলুপ চোখে জয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। জয়া আয়নার ভেতরের বাবলুর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। বাবলু - যদি মন চায় আমাকে স্মরণ কোরো, আমি রইব অপেক্ষায় যতক্ষণ না তোমার ডাক শুনব। গুড নাইট। বলেই সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জয়া এসে বাবলুর হাত ধরে.......।

ভালোবাসার রসায়ন কখন কাকে কীভাবে টানে, তা কেউ বলতে পারে না। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মনের মাঝে যখন অনুভূতি জাগ্রত হয়, তখন তাদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায়। এর ফলে মানুষের শরীরে একধরনের অ্যাবসেশন তৈরি হয়। এতে করে আবেগ কাজ করে বেশি। তখন আবেগে তাড়িত হয়ে বাস্তবতাকে হারিয়ে ফেলে। আর তখনই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালোবাসা মানুষকে অপরাধী করে তোলে।

সবুজ বাংলাদেশ থেকে ফিরে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জয়ার মুখে সারা দিনই বাবলুর প্রশংসা শুনতে শুনতে সবুজ একটু বিরক্ত বোধ করলেও জয়াকে সেটা বুঝতে দেয় না। সবুজ অফিস থেকে ফোন করে প্রায়ই জয়ার ফোন বিজি পায়। বাসায় ফিরে জয়ার ফোনের কল লিস্ট দেখে একটু অবাকই হয়। প্রতিদিন ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জয়া শুধু বাবলুর সাথে কথা বলেছে। ব্যাপারটা সবুজের কাছে একটু আনইউজাল মনে হলেও কিছু বলে না জয়াকে।

একদিন রাতে জয়া কিচেনে কাজ করছে, সবুজ ছেলেকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করে-বাবা যখন বাংলাদেশে ছিল, তখন তোমার খারাপ লেগেছিল? হ্যাঁ, খুব খারাপ লেগেছিল।ওরে বাবা, কেন খারাপ লেগেছিল আমার বাপজানের? মামি আদর করেনি? মামি আমার সাথে ঘুমাইওনি। আমার ভীষণ ভয় লেগেছে। মামি তোমার সাথে ঘুমায়নি! তাহলে কোথায় ঘুমিয়েছে? বাবলু আংকেলের সাথে ওই রুমে। হোয়াট! চিৎকার করে উঠেও সাথে সাথে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। তোমার বাবলু আংকেল কি আমাদের বাসায় ঘুমাত? তুমি বাংলাদেশে যাওয়ার পর তো আংকেল প্রতিদিন আমাদের বাসায় ঘুমাত।

সবুজের মাথায় যেন ব্জ্রপাত হলো। হার্টে কম্পন শুরু হলো। ‘জয়া জয়া’ বলে চিৎকার করে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল। বুদ্ধিমান সবুজ এই রাতের বেলা সন্তানের সামনে চিৎকার-চেঁচামেচি করে পরিবেশ ঘোলাটে করতে চায় না। কিন্তু এ ধরনের একটা খবর শোনার পর কোনো স্বামীর পক্ষে সম্ভব চুপ করে থাকা? ইম্পোসিবল। তার পরও সবুজ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে লাউঞ্জে গিয়ে দেখে, জয়া ফোনে কথা বলছে। সবুজকে দেখে জয়া আঁতকে ওঠে। কী ব্যাপার, তুমি ঘুমাওনি? আমি ঘুমাব আর তুমি অন্য পুরুষের সাথে প্রেম করবে? কী! কী বললে তুমি? এমন ভাব করছ যে কিছুই জানো না। এ জন্যই তুমি ওই ছেলেটাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুমি আমার স্ত্রী হয়ে আমার বাসায় আমার সন্তানের সামনে অন্য একটা ছেলের সাথে রাত কাটাবে! ও গড! বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও আমার বাসা থেকে। আমি তোমাকে... বলেই টি-টেবিলে রাখা ক্রিস্টালের ফুলের টপটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে এই বাসায় একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি রূপ নেয়। শব্দ আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে জয়ের ঘুম ভেঙে যায়। জয় ‘মা মা’ বলে চিৎকার করে ওঠে। জয়া রুমের দিকে গেলে সবুজ দৌড়ে এসে জয়ার হাত ধরে একটা হেঁচকা টান দিয়ে সোফার ওপর ফেলে দেয়। ডোন্ট টাস মাই সান। তোমার ওই নোংরা হাতে আমার সন্তানকে ধরবে না। সবুজ রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।

This e-mail address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it

সাম্প্রতিক