স্টাফ রিপোর্টার: পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলায় তাদের মেয়ে ঐশী রহমানের মৃত্যুদ-ের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় দিয়েছে হাই কোর্ট। আলোচিত এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামির আপিল শুনানি করে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার এই রায় দেয়। রায়ে হাই কোর্ট বলেছে, ঐশীর অপরাধ মৃত্যুদ-ের যোগ্য হলেও তার বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সাজা কমানোর এই রায় দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদ-ের সঙ্গে ঐশীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। হত্যায় সহযোগিতার জন্য ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমানকে বিচারিক আদালতের দেওয়া দুই বছরের কারাদ-ের রায় হাই কোর্টেও বহাল রাখা হয়েছে। হাই কোর্টে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহুরুল হক জহির; তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম। অন্যদিকে ঐশীর পক্ষে ছিলেন সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী। রাজধানীর চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট এসবি কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্নার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মাহফুজের ভাই মশিউর রহমান পরদিন পল্টন থানায় হত্যা মামলা করেন। পরদিনই নিহত দম্পতির মেয়ে ঐশী পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে তার বাবা-মাকে নিজেই খুন করার কথা স্বীকার করেন। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিচারক সাঈদ আহমেদ ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর এ মামলার রায় দেন। ঐশীকে মৃত্যুদ- দেওয়ার পাশাপাশি হত্যায় সহায়তার দায়ে ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমানকে দুই বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। তবে খালাস পান ঐশীর আরেক বন্ধু আসাদুজ্জামান জনি। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, হত্যাকা-টি ছিল পরিকল্পিত ও নৃশংস। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ঘটনার সময় আসামি ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। নৃশংস হত্যাকা- বিবেচনায় ঐশীকে ফাঁসির দ- দেওয়া হয়েছে। ওই বছর ডিসেম্বরে খালাস চেয়ে হাই কোর্টে আপিল করেন ঐশী। সেই সঙ্গে নিম্ন আদালতের রায় ও অন্যান্য নথি হাই কোর্টে আসে মৃত্যুদ-ের অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য। এরপর চলতিবছর ১২ মার্চ আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শুরু হয়। একটি মানবাধিকার সংস্থা ঐশীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে রিট আবেদন করার পর হাই কোর্টের দুই বিচারক গত ১০ এপ্রিল ওই তরুণীর বক্তব্য শোনেন। এ মামলায় ঐশীদের অপ্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মীকেও আসামি করা হয়। তার বিচার কিশোর আদালতে চলছে। দ- কমানোর কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যায় আদালত বলেন, পাঁচটি কারণে ঐশীর মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে।
এক. হত্যাকা-ের সময় ঐশী মাদকাসক্ত ছিলেন। এবং ১৪ বছর বয়স থেকেই তিনি সিসা, ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল এসব নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করতেন।
দুই. ঐশী বংশগতভাবে মানসিক রোগী। তাঁর চাচা-দাদি-খালা অনেকের মাঝেই মানসিক রোগের লক্ষণ আছে, যা তাঁর মাঝেও ছোটবেলা থেকে বিদ্যমান।
তিন. হত্যাকা-ের ঘটনার দ্বিতীয় দিনের মাথায় তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। এতে বোঝা যায়, তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
চার. ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর। এ বয়সের একটি সন্তানকে তাঁর বাবা-মা যথাযথ দেখভাল করেননি। ফলে ঐশী ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন।
পাঁচ. ঐশীর বাবা-মা দুজনেই সন্তানের লালনপালন বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। যে কারণে ছোটবেলা থেকেই তিনি স্নেহবঞ্চিত হয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
আর এই পাঁচ কারণ আমলে নিয়ে আদালত তাঁর মৃত্যুদ-ের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। রায় ঘোষণার পর ঐশীর আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী সাংবাদিকদের বলেন, রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব। ঐশীর আইনজীবী আরো বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, সাজা আরো কমবে বা খালাস পাবে। কেননা, মেডিকেল বোর্ড ঐশীর বয়স ১৯ নির্ধারণ করে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী যে চিকিৎসক বয়স নির্ধারণ করেন, তাঁকে আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে হয়। কিন্তু ঐশীর ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণকারী চিকিৎসক সেটি করেননি। এ ছাড়া ঐশী মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম জহিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আদালত পাঁচটি কারণ উল্লেখ করে ঐশীর মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। রায়ের কপি পাওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আইনজীবী বলেন, ঐশীর বয়স ও বংশগত মানসিক সমস্যা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্মসমর্পণ ও মাদকাসক্তিসহ সার্বিক বিবেচনা নিয়ে আদালত তাঁর দ- কমিয়েছেন।
< Prev | Next > |
---|