স্টাফ রিপোর্টার: সাক্ষির অনুপস্থিতির কারণে বিপুল সংখ্যক মামলার ন্যায়বিচার ব্যাহত হচ্ছে। কোনো কোনো মামলার সাক্ষিকে বার বার তাগিদই শুধু নয়, জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কয়েক বছর ধরেই সময়ের আবেদন করে যাচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ, আর বিনাবিচারে কারাগারে থাকতে হচ্ছে আসামিকে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজের ১৬টি আদালতে সাক্ষি ঠিকমতো হাজির না হওয়ায় এক যুগের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে প্রায় ৩ হাজার মামলার বিচার। তার মধ্যে ২৩ বছরের পুরনো মামলাও রয়েছে। ওসব মামলার প্রতিটিতেই বার বার সাক্ষি হাজিরের তারিখ বদলানো হচ্ছে। অথচ সাক্ষিদের হাজির করতে পারছে না পুলিশ। যদিও ফৌজদারি আইনের ১৭১(২) উপধারায় বলা রয়েছে, সাক্ষি হাজির করা পুলিশের কাজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাক্ষি খুুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কিনা তাও আদালতকে জানানো হচ্ছে না। দু-একটি ক্ষেত্রে অবশ্য 'ঠিকানা অনুসারে সাক্ষিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না' এমন দায়সারা প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অনেক ক্ষেত্রেই আসামিপক্ষ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে সাক্ষিদের আদালতে হাজির না করার ব্যবস্থা করে। কারণ তাতে ঝিমিয়ে পড়ে মামলার বিচার কার্যক্রম। আর তার সুফল পায় গুরুতর অপরাধের আসামিরা। দীর্ঘদিনেও সাক্ষ্য না নেয়ায় মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ফলে সাক্ষির অভাবে একদিকে গুরুতর অপরাধের আসামিরা মুক্ত হচ্ছে, অপরদিকে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেকে বিনাবিচারে বছরের পর বছর কারাগারে রয়েছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজের ১৬টি আদালতে ৫০ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তার মধ্যে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পুলিশ আদালতে সাক্ষি হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে এমন মামলা প্রায় ৫ থেকে ৭ শতাংশ।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরের একটি আদালতে মাদকদ্রব্য আইনের একটি মামলা দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে কোতোয়ালি থানায় ওই মামলা হয়েছিলো। সেটির আসামি মেহেদী হাসান এখন জামিনে আছেন। ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট আদালত ওই মামলার চার্জ গঠন করেন। তার পর প্রায় ১৫ বছর কেটে গেলেও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। মোট ১১ জন সাক্ষির মধ্যে ৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। যাদের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি তারা হলেন সিআইডির তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক শেখ আলী হায়দার, সিআইডির পরিদর্শক পরিতোষ বণিক, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার তুলা পুষকুরনী গ্রামের মো. শাহজাহান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার শ্যামবাড়ী গ্রামের মো. ইউনুস চৌধুরী। অপর ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর সাক্ষির নাম-ঠিকানা চার্জশিটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এমন আরেকটি মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় রাজধানীর লালবাগের বেগমবাজার এলাকার মো. মুকিম ওরফে জাফর ২০০১ সালের আগস্টে রমনা এলাকায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। পুলিশ তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে। ২০০২ সালে ওই মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। একই বছরের ১৪ নভেম্বর আদালত একমাত্র আসামি জাফরের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। তারপর ১৪ বছর পেরোলেও ৮ জনের মধ্যে ৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি রয়েছে। জাফর এখন জামিনে আছেন। মামলাটি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। তেজগাঁও থানায় সায়েদুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলার নথি ঘেটে জানা যায়, মামলার বাদি তেজগাঁও থানার তৎকালীন এসআই তরিকুল ইসলাম, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) এসআই মোমিনুল ইসলাম, মামলা রেকর্ড কর্মকর্তা (আরও) এসআই মো. হাবিবুর হক প্রধান, কনস্টেবল আবদুল আজিজ, হাসেম আলী ও কামরুজ্জামান এবং পথচারী চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার পূর্ব আলোনিয়া গ্রামের মো. রুহুল আমিন, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার বাগাকান্দি গ্রামের আসাদ বেপারী ও চাঁদপুর সদর থানার বাকেরপুর গ্রামের মোস্তফা। একজন কর্মকর্তা একটি থানায় সাধারণত দুই থেকে তিন বছরের মতো কর্মরত থাকেন। ওই কারণে ওই কর্মকর্তা ও কনস্টেবলরা ইতিমধ্যেই বদলি হয়ে গেছেন। তবে পুলিশের কোন সদস্য কোথায়, কবে বদলি হয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন তা রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশের এসিআরও শাখায় লিপিবদ্ধ থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলেই তাদের আদালতে সাক্ষি দিতে হাজির করা সম্ভব।
সূত্র আরো জানায়, ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন আদালতের পৃথক ৩০টি হত্যা ও অস্ত্র মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে ওসব মামলায় সাক্ষি হিসেবে ১শ জনের বেশি পুলিশ সদস্য ও ২৭০ জনের বেশি সাধারণ সাক্ষিকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। প্রতিটি মামলার চার্জশিটে সাক্ষিদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা রয়েছে। আদালত প্রথমে সাক্ষিদের ওই ঠিকানা অনুসারে সমন পাঠানোর আদেশ দেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এক যুগ পেরোলেও একজনেরও সাক্ষ্য হয়নি এমন মামলার সংখ্যাও অনেক।
এদিকে সাক্ষি হাজির না হওয়া প্রসঙ্গে পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষিরা স্থান পরিবর্তন করায় তাদের নতুন ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাদের সন্ধান করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে আদালত সংশ্লিষ্ট নেতৃস্থানীয় আইনজীবীরা বলছেন, সাধারণত মাদক ও অস্ত্র মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ চার্জশিটে ভাসমান লোকদের সাক্ষি করে। ফলে তাদের পরে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার অনেকে সাক্ষ্য দিতে রাজিও হন না। তাছাড়া থানায় সাক্ষিদের প্রতি সমন গেলে পুলিশ আগ্রহ না দেখিয়ে ওয়ারেন্ট নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকেন। আবার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাধারণ সাক্ষিরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পান। সেজন্য চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোয় দিনের পর দিন সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। তবে মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকার সম্পূর্ণ ত্রুিিট পুলিশের নয়। কারণ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সাক্ষি না এলেও প্রতিটি বিচারকের ক্ষমতা রয়েছে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার। পুলিশ-আইনজীবী-বিচারক মিলে ইচ্ছা করলেই বিচার কাজ দ্রুত করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, দীর্ঘদিন আদালতে সাক্ষি না এলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। তাতে আসামিপক্ষ সুবিধা নেয়। আবার পুলিশ নাম ও ঠিকানা যাচাই-বাছাই করে চার্জশিটে সাক্ষিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। অথচ তারাই আবার সাক্ষি হাজিরের সময় ওইসব সাক্ষীকে খুঁজে পায় না।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, আদালতে সাক্ষি হাজিরের ক্ষেত্রে পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকার সচেষ্ট রয়েছে। মামলার বিচার দীর্ঘ হোক, তা কারও কাম্য নয়। সেক্ষেত্রে তদন্তে দায়িত্বে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশেষত মামলা করেও পুলিশের যেসব সদস্য আদালতে সাক্ষি দিতে উপস্থিত হচ্ছেন না, তাদের জবাবদিহি করতে হবে। সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ
< Prev | Next > |
---|