স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় শোক দিবসে রাজধানীর পান্থপথে একটি হোটেলে ‘হামলার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা চলাকালে সেখানে এক জঙ্গি আত্মঘাতী হয়।
সর্বশেষ ময়মনসিংহের ভালুকায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু বোমা, গ্রেনেড এবং বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল।
সেখানে আধা-পাকা একটি বাড়িতে বিস্ফোরণে একজন নিহত হয়। এর আগে সারাদেশে বেশ কিছু জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মূলত গতবছর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পরই দেশে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম আমূল বদলে যায়। এক বছর আগে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ওই জঙ্গি হামলার পর নড়েচড়ে বসে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দেশজুড়ে জঙ্গিবিরোধী অনেকগুলো অভিযান চালিয়ে তাদের নেটওয়ার্ক তারা তছনছ করে দেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার পাশাপাশি তাদের সচেতনতামূলক প্রচারে সাধারণ মানুষও সতর্ক হয়, ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জঙ্গিরা।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গত এক বছরে ২৬টি আস্তানায় সফল অভিযানে ৫৬ জনসহ ৭২ জঙ্গি নিহত হয়েছে। জনসচেতনতা এবং সমন্বিত কার্যক্রমের কারণে এক বছরের মধ্যেই হলি আর্টিজান হামলার নেপথ্যের পুরো ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, হলি আর্টিজানের ঘটনায় একের পর এক অভিযানে শীর্ষ জঙ্গিরা নিহত হয়েছে, ধরা পড়েছে অনেকে। তা ছাড়া ওই হামলার পর দেশে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতা তৈরি হয়েছে। জঙ্গিরা এখন আর সহজে বাসা ভাড়া নিয়ে আস্তানা গড়তে পারছে না। শনাক্ত হয়ে যাচ্ছে পরিবার ছেড়ে জঙ্গিদলে যোগ দেওয়া তরুণরা। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই পুলিশ ও র্যাবকে মোবাইল ফোনের অ্যাপসে বা ফোন করে খবর দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন স্থানে গঠন করা হয়েছে জঙ্গিবিরোধী কমিটি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সফলতায় সন্তুষ্টিতে না ভুগে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। কারণ দেশে জঙ্গিদের অপতৎপরতা এখনো আছে। সাময়িক হয়তো সীমিত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এখন দেশে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম চলছে জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থনে। মানুষ এখন প্রশাসনকে সহায়তা করছে।
সঠিক সময় সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজটি করতে পেরেছে। এ কারণেই সাফল্য আসছে। তবে এটি ধরে রাখতে হবে।
এদিকে, জঙ্গি দমনে গঠিত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম মনে করছেন, হলি আর্টিজানে হামলার সময়টি ছিল জঙ্গিদের পিক টাইম, পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তাদের নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত করে ফেলা হয়।
তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে তারা আবার সংগঠিত হতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই থেকে টানা অভিযানে তাদের সেই সামর্থ্য পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। হলি আর্টিজানের মতো হামলা করার সামর্থ্য বা শক্তি কোনোটাই এখন জঙ্গিদের নেই। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে।
তবে পলাতকদেরও ধরে ফেলার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। গত বছরের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি এবং ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদগাহের কাছে জঙ্গি হামলায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। এরপর আত্মগোপনে থাকা তরুণদের জঙ্গিদলে যোগ দেওয়ার তথ্য উঠে আসে। নিখোঁজ তরুণদের তালিকা তৈরি এবং জঙ্গি তৎপরতার তথ্য সংগ্রহ শুরু করে পুলিশ ও র্যাব। গত বছরের ১১ জুলাই র্যাব চালু করে ‘রিপোর্ট টু র্যাব’ নামের অ্যাপ।
এরপর ১ আগস্ট ডিএমপি চালু করে ‘হ্যালো সিটি’ নামের আরেকটি অ্যাপ। এ ছাড়া পুলিশের সদর দপ্তর ‘ওপিনিয়ন অর কমপ্লেইন’ এবং ‘বিডি হেল্প লাইন’ নামে দুটি অ্যাপস চালু করে। এতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। চারটি অ্যাপসে গত এক বছরে প্রায় ২৫ হাজার অভিযোগ এসেছে। সেই সূত্র থেকে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা ও কর্মকা-ের ব্যাপারে অনেক তথ্য পেয়েছে পুলিশ ও র্যাব।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থী ১০ দিন অনুপস্থিত থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট করতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে জঙ্গিবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ে ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে জঙ্গিবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে এক লাখ আলেম জঙ্গিবিরোধী ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন। জঙ্গিবিরোধী ধর্মীয় বয়ানসহ খুতবা তৈরি করে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররামসহ সারা দেশে সরবরাহ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
রেডিও-টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন এবং প্রচারপত্র বিলিসহ বিভিন্ন প্রচারের কারণে অভিভাবকরাও সচেতন হয়ে ওঠে। এখন সন্তান নিখোঁজ হলেই তার অভিভাবকরা পুলিশের কাছে তথ্য দেন। অন্যদিকে গত বছরের শুরু থেকে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও তা চলছিল ধীরগতিতে।
হলি আর্টিজান হামলার পর রাজধানীতে এই কার্যক্রম গতি পায়। এখন প্রায় ৩০ লাখ তথ্য ফরম পূরণ করা হয়েছে। জঙ্গি দমন কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থার ব্যাপারে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, হলি আর্টিজান হামলার পর দেশের ৯৯.৯ শতাংশ মানুষ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের সুস্পস্ট অবস্থান ব্যক্ত করে। একটি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। লোকজনের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রতিবেশী, সুধীসমাজ, সংগঠন, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, ধর্মীয় অঙ্গন-সব দিক থেকে জঙ্গি বিরোধী ভূমিকা অব্যাহত থাকলে দ্রুত জঙ্গি নিমূল করা যাবে।
< Prev | Next > |
---|