স্টাফ রিপোর্টার: ইউরোপের ২৮টি দেশ একযোগে বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তার আগে অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও ব্রিটেনও এক কারণে তালিকাভুক্ত করে। এর ফলে আকাশপথে কার্গোবাহী বিমান তৃতীয় কোনো দেশে স্ক্যানিং না করে কার্গোবাহী বাংলাদেশের কোনো বিমান সরাসরি ইউরোপে যেতে পারবে না। গত ১ জুন থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো বাংলাদেশের কার্গোবাহী বিমানের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে। অভিযোগ রয়েছে, সিভিল এভিয়েশনের গড়িমসি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সিভিল এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নিরাপত্তার স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া সুপারিশ আমলে না নেওয়ার কারণেই পুরো ইউরোপেই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে বাংলাদেশের আকাশপথে পণ্যপরিবহণ। ওই নিষেধাজ্ঞার ফলে বছরে ৩০ হাজার ৪শ’ কোটি টাকার কার্গো পণ্য রফতানি হুমকির মুখে পড়েছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ হচ্ছে। ওই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশকে তৃতীয় কোনো দেশে গিয়ে কার্গোতে যেসব পণ্য থাকবে তা নতুন করে স্ক্যান করতে হবে। সেজন্য অতিরিক্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হবে রফতানিকারককেই। তাতে পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়বে। পাশাপাশি ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠাতে অতিরিক্ত সময়ও ক্ষেপণ হবে। এদেশ থেকে অধিকাংশ তৈরি পোশাকই নৌপথে রফতানি হয়। তবে কখনো কখনো ব্যবসায়িরা বিপদে পড়লে লোকসান দিয়ে উড়োজাহাজেও পণ্য রফতানি করে। মূলত সমুদ্রপথে কোনো বাধা সৃষ্টি হলে বিদেশি ক্রেতার প্রতিশ্রুত রক্ষায় লোকসান দিয়েই আকাশপথে পোশাক রফতানি করা হয়। কারণ আকাশপথে পোশাক রফতানিতে ব্যাপক লোকসান। কিন্তু বর্তমানে নতুন করে তৃতীয় দেশে পণ্য চেকিং হলে নতুন করে ব্যবসায়িদের আরো ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
সূত্র জানায়, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ২০১৬ সালের মার্চে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাজ্য। তারপর অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিও পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে যুক্তরাজ্যের পরামর্শে শাহজালালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পায় ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেড লাইন। প্রতিষ্ঠানটি সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশিসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের পরামর্শ দেয়। সেই প্রেক্ষিতে সরকারও বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় একটি বিশেষ প্রকল্প গতবছরের ৮ মার্চ একনেকে অনুমোদন দেয়। সিভিল এভিয়েশনকে উচ্চ মাত্রার স্ক্যানিং মেশিন, এক্সপ্লোসিভ ডিটাকশন সিস্টেম (ইডিএস) স্থাপন ও ডগ স্কোয়াডের জন্য ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে বিমান মন্ত্রণালয় থেকে কার্গো কমপ্লেক্সে উচ্চ পর্যায়ের স্ক্যানিং মেশিন বসানোর জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়। কিন্তু প্রথম দফায় প্রাক্কলিত ব্যয় ১৬ কোটি টাকা বেড়ে যাওয়ায় ওই টেন্ডার বাতিল করা হয়। প্রথম দফায় প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ১০৬ কোটি টাকা। পরে দ্বিতীয় দফায় টেন্ডার করতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত অনুযায়ী যথাসময়ে এক্সপ্লোসিভ ডিটাকশন সিস্টেম (ইডিএস) ক্রয়ে ব্যর্থ হয় সিভিল এভিয়েশন। এক্সপ্লোসিভ ডিটাকশন সিস্টেম নামের দুটি মেশিনের বাজারদর সর্বোচ্চ ৩০ কোটি টাকার বেশি না। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের একটি চক্র তাদের পছন্দের কোম্পানি কাজ না পাওয়ায় নানা টালবাহানায় ইডিএস মেশিনটি ক্রয় করতে বিলম্ব হয়। ওই কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রি-স্ক্যান করার শর্ত দিয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন ও বিমানকে চিঠি দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কার্গো পণ্য তাদের দেশগুলোতে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে কার্গো পণ্য ইইউভুক্ত সিভিল এভিয়েশন অনুমোদিত দ্বিতীয় কোনো দেশ থেকে রি-স্ক্যান করে নিলে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। তাছাড়া বিমানের কার্গো রফতানি টার্মিনালটি বহিরাগত জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। পণ্য স্ক্যানিংয়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের গাফিলতি ও অবহেলাও রয়েছে। বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের বৃহত্তম বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ওই নিষেধাজ্ঞার ফলে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী বেশ কিছু পণ্য পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে। মোট রফতানির মধ্যে বিমানে পরিবহন করা হয় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। টাকার হিসাবে এর পরিমাণ ৩০ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা। বাকিটা রফতানি হয় জলপথে। অবশ্য জলপথে রফতানি পণ্য তৃতীয় কোনো দেশে স্ক্যান করার কোনো শর্ত ইইউর নেই।
এদিকে ইইউর বিধিনিষেধ আরোপের পর থেকেই ক্যাথে প্যাসিফিক ও ড্রাগন এয়ারের কার্গোতে পণ্য পরিবহন হচ্ছে না। শুধু টার্কিশ, ইতিহাদ, কাতার এয়ারওয়েজসহ কয়েকটি এয়ারলাইন্সে পণ্য পরিবহন হচ্ছে। তবে তাও আগের চেয়ে কমে গেছে। তারপরও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক কাজী ইকবাল করিম জানান, ইইউর সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কার্গো পণ্য পরিবহনে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ যে এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে কার্গো পণ্য নিয়ে যাবে, তারা চাইলে দুবাই ও জেদ্দায় দ্বিতীয় ধাপে স্ক্যান করতে পারবে।
অন্যদিকে বিমানের পরিচালক (মার্কেটিং) আলী আহসান বাবু জানান, ইইউ কার্গো রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও তৃতীয় দেশে স্ক্যানিং হয়ে কার্গো পণ্য গেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ইতিমধ্যে ইইউর শর্ত অনুযায়ী ইডিএস মেশিন বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইইউর বিধিনিষেধ আরোপের পর ৬ জুন বিমানবন্দরে ঢাকা মহানগর পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ডগ স্কোয়াড দিয়ে স্ক্যানিং-এর মহড়া পরিচালনা করে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এএপিবিএন) সিনিয়র সহকারী সুপার জিয়াউল হক জানান, ‘বিমানবন্দরের জন্য এপিবিএন ডগ স্কোয়াড গঠনের কাজ শুরু করেছে। কুকুর রাখার শেড নির্মাণের কাজ চলছে। শিগগিরই প্রশিক্ষিত কুকুর কেনা হবে।’ আর বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে সিভিল এভিয়েশনের কার্যক্রমে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। বিমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে দুটি এক্সপ্লোসিভ ডিটাকশন মেশিন কার্গো ভিলেজে বসানোর কাজ চলছে। আগস্টের মধ্যে তা বাস্তবায়ন হবে।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, ইতিমধ্যে ইডিএস মেশিন কেনা হয়েছে। মেশিনটি শিপমেন্টের অপেক্ষায় আছে। ইন্সপেকশনের জন্য ১৯ জুন সিভিল এভিয়েশনের টিম যাবে। আশা করা যায় জুলাই বা আগস্টের মধ্যে এসে যাবে। ইডিএস এলে আমরা কার্গোতে দিয়ে দেব। স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের আর অসুবিধা থাকবে না।
< Prev | Next > |
---|