বার্মিংহাম : ওপেনার রোহিত শর্মার সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশকে হারিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির অষ্টম আসরের ফাইনালে উঠলো বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারত। আজ টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বাংলাদেশকে ৯ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে টিম ইন্ডিয়া। আগামী ১৮ জুন লন্ডনের কেনিংটন ওভালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে শিরোপা ধরে রাখার মিশনে মাঠে নামবে বিরাট কোহলির দল।
টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৬৪ রান করে বাংলাদেশ। জবাবে ৫৯ বল হাতে রেখে জয় নিয়ে ফাইনালের টিকিট কাটে ভারত।
জয়ের জন্য ২৬৬ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে যথারীতি ভারতকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন দলের দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান। বাংলাদেশ বোলারদের কোন প্রকার সুযোগ না দিয়ে ৮৮ বল মোকাবেলা করে ৮৭ রানের জুটি গড়েন তারা। রোহিত-ধাওয়ানের জুটি ভাঙ্গেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। ৭টি চার ও ১টি ছক্কায় ৩৪ বলে ৪৬ রান করে আউট হন ধাওয়ান। সেই সাথে এবারের আসরে এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে ভারতের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান করার মাইলফলক স্পর্শ করেন ধাওয়ান।
ধাওয়ানের বিদায়ের পর ভারতের হাল ধরেন রোহিত ও কোহলি। দু’জনেই বাংলাদেশ বোলারদের উপর ব্যাট হাতে ছড়ি ঘুড়িয়েছেন। তাতে সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভারতের জয়ের পথ পরিষ্কার হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত হাসতে হাসতে জয়ের স্বাদ নেয় ভারত। সেই সাথে টানা দ্বিতীয় ও চতুর্থবারের মত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিতে উঠলো টিম ইন্ডিয়া।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১১তম ও বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির স্বাদ নিয়ে ১২৩ রানে অপরাজিত থাকেন রোহিত। তার ১২৯ বলের ইনিংসে ১৫টি চার ও ১টি ছক্কা ছিলো।
৪ রানের জন্য সেঞ্চুরি না পেলেও, দ্রুত ৮ হাজার রান করার রেকর্ড গড়েছেন কোহলি। নিজের ১৭৫তম ইনিংসে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৮ হাজার রান পূর্ণ করেন কোহলি। আর ১৮২ ইনিংসে ৮ হাজার রান পূর্ণ করে এতোদিন এই রেকর্ডের মালিক ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ানডে অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্স।
রেকর্ড গড়া ইনিংসে ১৩টি বাউন্ডারিতে ৭৮ বলে ৯৬ রানে অপরাজিত থাকেন কোহলি। তবে ম্যাচের সেরা হয়েছেন রোহিত।
এর আগে, সেমিফাইনালের মঞ্চে টস ভাগ্যে হেরে যান বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। এতে যে মাশরাফিদের পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে, তা টস হারের পর টাইগার দলপতির ভাষ্য সেটি বলে, ‘আমাদের পরিকল্পনায় প্রথমে বোলিং ছিলো।’ কিন্তু টস জিতে প্রথমে বোলিং নেয় ভারত।
ব্যাটিং-এ নেমেই ইনিংসের প্রথম ওভারের শেষ বলে শূন্য হাতে বিদায় নেন বাংলাদেশের ওপেনার সৌম্য সরকার। ভারতের পেসার ভুবেনশ্বর কুমারের ডেলিভারি ড্রাইভ করতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে উইকেট ভাঙ্গে সৌম্যর।
এরপর উইকেটে যান তিন নম্বরে নামা সাব্বির রহমান। ভারতীয় বোলারদের চাপ সৃষ্টি করতে নিজের প্রথম মুখোমুখি হওয়া বলেই বাউন্ডারি হাঁকান সাব্বির। এখানেই থেমে যাননি সাব্বির। এরপর দর্শনীয় আরও ৩টি চার মেরেছেন, সাহস যুগিয়েছেন বাংলাদেশকে। তাই সাব্বিরকে দিয়ে ভারতীয় বোলারদের লাইন-লেন্থহীন করার ছক কষে ফেলেন অন্যপ্রান্তে থাকা আরেক ওপেনার তামিম। এক প্রান্ত আগলে তামিম ছিলেন ধীর।
কিন্তু তামিম-সাব্বিরের সেই পরিকল্পনা নসাৎ করে দেন ভুবেনশ্বর। ১৯ রান করা সাব্বিরকে বিদায় দেন ভুবি। ২১ বল মোকাবেলা করে ৪টি চারে নিজের ইনিংসটি সাজান সাব্বির।
দলীয় ৩৬ রানে সাব্বির ফিরলে, উইকেটে তামিমের সঙ্গী হন উইকেটরক্ষক মুশফিকুর। উইকেটে সেট হতে শুরুতে দেখেশুনে খেলেছেন তারা। সেটি কাজে লেগেছে, তাই বড় জুটি গড়ার সাহস পেয়ে যান তামিম-মুশফিকুর।
দ্বিতীয় উইকেটে ভারতীয় বোলার সকল পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিয়েছেন তামিম-মুশফিকুর। তাই তাদের জুটির রান অবলীলায় তিন অংকে পা রাখে। তা করতে গিয়ে নিজের নামের পাশে অর্ধশতকের সংখ্যাও রাখতে পারেন তারা।
এসমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বারবার বোলারদের প্রান্ত পরিবর্তন করেও মুখে চওড়া হাসি হাসতে পারছিলেন না তিনি। তাই ২৬তম ওভারে অকেশনাল বোলার হিসেবে কেদার যাদবকে আক্রমণে নিয়ে আসেন কোহলি। প্রথম ওভারে ৬ রান কেদার। তারপরও তাকে দিয়ে জুয়া খেললেন কোহলি। তাই ২৮তম ওভারেও কেদারের হাতে বল তুলে দিলেন কোহলি।
আর তাই কোহলির জুয়ার কাছেই হার মানেন তামিম। ২৮তম ওভারের চতুর্থ-পঞ্চম রান নিতে না-পারায় ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন তামিম। তাই পরের ডেলিভারিটি বুদ্ধিমত্তার সাথে করেছিলেন কেদার। সেটি মিড-উইকেট দিয়ে মারতে গিয়ে বল মিস করে বোল্ড হন তামিম। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩৮তম হাফ-সেঞ্চুরি পাওয়া ইনিংসে ৭টি চার ও ১টি ছক্কায় ৮২ বলে ৭০ রান করেন তামিম। সেই সাথে এবারের আসরে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের তালিকায় নিজের নামও তুলে এই বাঁ-হাতি।
মুশফিকুরের সাথে তৃতীয় উইকেটে ১২৭ বলে ১২৩ রান যোগ করেন তামিম। তার বিদায়ের পর সাকিব আল হাসানকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন মুশফিকুর। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি ভারতের বাঁ-হাতি স্পিনার রবীন্দ্র জাদেজা কারণে। জাদেজা ডেলিভারিতে উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়ে সাকিবকে ১৫ রানে থামিয়ে দেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।
১৮২ রানে চতুর্থ উইকেট পতনে কিছুটা চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দেন তামিমকে শিকার করে ভারতকে ব্রেক-থ্রু এনে দেয়া কেদার। উইকেটে সেট হয়ে যায় মুশফিকুর এবার শিকার হন কেদারের। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২৬তম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে ৮৫ বলে ৬১ রান করেন মুশি। তার ইনিংসে ৪টি চার ছিলো।
৩৬তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ১৮৪ রানে উপরের সারির সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান ফিরে যাবার ফলে বাংলাদেশের রান ভালো অবস্থায় নিয়ে যাবার দায়িত্ব লোয়ার-অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বটা ভালোভাবে পালন করতে পারেননি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মোসাদ্দেক হোসেন। ছোট-ছোট দু’টি ইনিংস খেলে থেমে যান মাহমুদুল্লাহ-মোসাদ্দেক। মাহমুদুল্লাহ ২৫ বলে ২১ ও মোসাদ্দেক ২৬ বলে ১৫ রান করেন।
মাহমুদুল্লাহ-মোসাদ্দেক ফিরে যাওয়ায়, বাংলাদেশের স্কোর আড়াইশ’ পৌঁছায় কি-না এটি নিয়ে জাগে প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মাশরাফি। আট নম্বর ব্যাট হাতে নেমে ৫টি বাউন্ডারিতে ২৫ বলে অপরাজিত ৩০ রান করে বাংলাদেশের স্কোর ৭ উইকেটে ২৬৪ রানে পৌঁছে দেন ম্যাশ। শেষদিকে মাশরাফিকে সঙ্গ দিয়েছেন আরেক পেসার তাসকিন আহমেদ। ১টি চারে ১৪ বলে অপরাজিত ১০ রান করেন তাসকিন। ভারতের ভুবেনশ্বর-বুমরাহ-কেদার ২টি করে উইকেট নেন।
স্কোরকার্ড:
বাংলাদেশ ইনিংস:
তামিম ইকবাল ব যাদব ৭০
সৌম্য সরকার ব কুমার ০
সাব্বির রহমান ক জাদেজা ব কুমার ১৯
মুশফিকুর রহিম ক কোহলি ব যাদব ৬১
সাকিব আল হাসান ক ধোনি ব জাদেজা ১৫
মাহমুদুল্লাহ ব বুমরাহ ২১
মোসাদ্দেক হোসেন ক এন্ড ব বুমরাহ ১৫
মাশরাফি অপরাজিত ৩০
তাসকিন অপরাজিত ১১
অতিরিক্ত: (লেবা-৮, ও-৭, নোব-২, পেনাল্টি-৫) ২২
মোট: (৭ উইকেট, ৫০ ওভার) ২৬৪
উইকেট পতন: ১-৬, ২-৩৬, ৩-১৫৯, ৪-১৮২, ৫- ১৯৪, ৬-২১৮, ৭- ২২৯
বোলিং:
বি কুমার ১০-১-৫৩-২(ও-১),
জে বুমরাহ ১০-১-৪০-২,
আর অশ্বিন ১০-০-৫৪(ও-৩),
এইচ পান্ডে ৪-৩৪-০(নেব-২,ও-২),
আর জাদেজা ১০-০-৪৮-১,
কে জাদব ৬-০-২২-২(ও-১)।
ভারত ইনিংস:
রোহিত শর্মা অপরাজিত ১২৩
শিখর ধাওয়ান ক মোসাদ্দেক ব মাশরাফি ৪৬
বিরাট কোহলি অপরাজিত ৯৬
অতিরিক্ত : ০
মোট: (৪০.১ ওভার, ১ উইকেট) ২৬৫
উইকেট পতন: ১-৮৭,
বোলিং:
মাশরাফি ৮-০-২৯-১,
মুস্তাফিজ ৬-০-৫৩-০,
তাসকিন ৭-০-৪৯-০,
রুবেল হোসেন ৬-০-৪৬-০,
সাকিব ৯-০-৫৪-০,
মোসাদ্দেক হোসেন ২-০-১৩-০,
মাহমুদুল্লাহ১-০-১০,
সাব্বির রহমান ১-০-৭-০।
ফল: ভারত ৯ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা: রোহিত শর্মা(ভারত)
< Prev | Next > |
---|