tyfwdgf6-মাহমুদুল বাসার

১৮ ফেব্রুয়ারি, ড. আনিসুজ্জামানের জন্মদিন। ১৯৩৭ সালের এই দিনে তিনি পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমায়, মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞান তাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বসিরহাটের মানুষ। ড. আনিসুজ্জামানের আত্বজীবনী ‘কালনিরবধি’ তে পেয়েছি তাদের সঙ্গে, ড. শহীদুল্লাহর ছিলোু পারিবারক সম্পর্ক। ড. আনিসুজ্জামানের পিতামহ বিখ্যাত বাঙালি মুসলমান লেখক শেখ আব্দুর রহিম। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হযরত মুহাম্মদের জীবন চরিত ও ধর্মনীতি’। শেখ আব্দুর রহিমের যুক্তি ও বিচার বোধ ড. আনিসুজ্জামান উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন।
ড. আনিসুজ্জামানের পিতা প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার এ,টি,এম, মোয়াজ্জম। তার মা সৈয়দা খাতুন কবিতা লিখতেন। তারস কাব্যের নাম ‘হাতেম তাই’।
একটা সময় পর্যন্ত ড. আনিসুজ্জামান কলকাতায় কাটালেও দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকায় তাঁর শিক্ষা জীবন কাটে। এরপর বিদেশ থেকেও ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ে কিছুটা সময় শিক্ষকতা করলেও দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলাই বাহুল্য যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সেখানে শিক্ষক হিসেব পেয়েছিলেন শহীদ মুনীর চৌধুরিকে। ড. আনিসুজ্জামানের সামগ্রিক মানসপট গঠনে মুনীর চৌধুরীর প্রভাব মূল্যবান, তার ‘মুনীর চৌধুরী’ গ্রন্থে এর আন্তরিক বর্ণনা আছে।
কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন, কিন্তু তাঁর মধ্যে রাজনীতি সচেতনতা প্রখর ভাবেই কাজ করে। ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। আন্তরিকতা ছিলো প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় আগত হলে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্থান-পতন সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন, তাঁর চেতনা প্রবাহের মধ্যে সে প্রভাব কাজ করেছে। তার ‘কাল নিরবধি’ ও ‘আমার একাত্তর’ পড়লে তা বোঝা যায়।
বঙ্গবিবেক আবুল ফজল, মহিয়সী কবি সুফিয়া কামালের পর আমরা আমাদের জীবনে বাঙালি বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে পেয়েছি জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরি ও ড. আনিসুজ্জামানকে। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদের রক্ত থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে ফুল ফুটেছিলো, তার অপ্রতিহত প্রভাব ড. আনিসুজ্জামানের মেধা ও মননে, রক্তকণিকায় প্রবাহিত। তার একটি বইয়ের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর’। সেখানে একটি প্রবন্ধ আছে। নাম, ‘বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাদেশী’। এই প্রবন্ধে বাঙালিত্বের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। আবুল মনসুর আহমদ, বদরুদ্দীন উমর ও ড. আহমদ শরীফের মত লেখক-তাত্ত্বিক-পন্ডিতরা বাঙালিত্বকে যেভাবে বনডেম করেছেন, তিনি সে সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বাঙালিত্ব বোধক বিশ্লেষণ দিয়েছেন। এ প্রবন্ধে তাঁর যুক্তির পরম্পরা নিখুত।
ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আমরা বাঙালি কিনা সে প্রশ্ন কেউ করেনি। ১৯৬৯ সালে শ্লোগান উঠেছিলো, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা দাবি করেছি, এ প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ।’ অসহযোগ আন্দোলনের সময় শ্লোগান উঠেছিলো- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো’ তখন কেউ এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। ‘জয়বাংলা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি সঠিক কিনা, প্রশ্ন তোলা শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। যখন পাকিস্তানি ভাবধারার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘আমাদের এই বাঙালি পরিচয় ও এই বাঙালি সত্তা ইতহাসের একটা ধারার মধ্যে দিয়ে বয়ে এসেছে। বাঙালির ইতিহাস সুদীর্ঘ কালের ইতিহাস। সে ইতিহাসের ধারাবাহিকতার যে উত্তরাধিকার, তা আমরা নিজের বলে দাবি করি।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সবচেয়ে সংকটে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা। বিএনপি ঘরনার বামপন্থীরা এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে মুরগী সাপ্লাই দেয়া বামপন্থীরা পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ড. আনিসুজ্জামান ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রবন্ধ লেখার প্রয়োজন মনে করেছেন। এই প্রবন্ধে বলেছেন, ‘যে বাড়ি-ঘর উপাসনার জন্য নির্মিত নয়, তা সেক্যুলার; যে শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মের পাঠ দেয় না, তা সেকুলার; যে ভাবধারা পার্থিব বিষয়ে সীমাবদ্ধ তা সেকুলার।’
আরো বলেছেন, ‘কোনো জোটের সঙ্গে যে দেশের যোগ নেই, সেই দেশ জোট নিরপেক্ষ, কোনো দলের সঙ্গে যে মানুষের সংস্রব নেই, তিনি দলনিরপেক্ষ। সুতরাং ধর্মের সঙ্গে যে বিষয়ের সম্পর্ক নেই, তা ধর্ম নিরপেক্ষ, ধর্মের সঙ্গে যে রাষ্ট্রের সংস্রব নেই, তা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’
আমরা জানি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতা প্রত্যাবর্তন করেছিলো। ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে আন্তরিক অভিব্যক্তি প্রত্যাশিত ছিল, এখন পিছন ফিরে মনে হচ্ছে, ১৯৭২-৭৩ সালেই তার অভাব দেখা দিয়েছিল। ১৯৭১-এ যারা হিন্দুর সম্পত্তি দখল করেছিলেন, ১৯৭২- এ ফেরত দিতে তাদের অনেকেরই অনিচ্ছা ছিল। কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত ফেরত দেননি এবং এ সব বিষয়ে সরকারের কাছে নালিশ করেও প্রতিকার পাওয়া যায় নি। তার থেকেই বোঝা যায় যে, বিষের ক্রিয়া নতুন করে দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বিধ্বস্ত রমনা কালীবাড়ি পুন নির্মাণের দাবি কোন সরকারই পূরণযোগ্য বিবেচনা করেনি। বেতার-টেলিভিশনের অন্যধর্মগ্রন্থ পাঠও অনেকের মনোপুত হয়নি। ১৯৭২-৭৩-এর পূজোর সময়ে কোথাও কোথাও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল যে, তুলনায় পাকিস্তান আমল অনেক নিরাপদ ও সহনশীল ছিল বলে অনেকে মনে করেছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতার উচ্ছেদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন পর্যন্ত সময়টায় নানাভাবে মুসলমান-অমুসলমানের ভেদ প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ ফিরে আসায় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা ক্ষমতাশীন হওয়ার সুযোগ ফিরে পাওয়ায় ধর্মীয় জিগির তুলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আক্রমণ ও স্থানচ্যুত করার প্রয়াস যেমন দেখায় যায় তেমনি ধর্মীয় বিভেদের কথাটাও খুব সামনে টেনে আনা হয়।’
তারপরও বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে ও পরের পার্থক্য আছে। তখনো সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। তখনো ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিলো রাষ্ট্রের নীতিমালা, সাম্প্রদায়িকতা নয়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘যা এখানে বড় হয়ে উঠেছে, তা হলো অনুক্ত হিন্দু ও অকথিত মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য। ১৯৭১ সালের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভিত্তিক এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ উপস্থাপিত হয়েছিলো। তাই মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রসঙ্গে এতে স্থান পায় নি, পাওয়ার কথা নয়। একই কারণে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসারে মুক্তিযুদ্ধের কথাটা গৌণ করে তোলার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।’(মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর-আগামী,১৯৯৯)।
ড. আনিসুজ্জামানের প্রথম গ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’। ১৯৬৪ সালে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিলো। আদমজী পুরস্কার পেয়েছেন বইটির জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পি-এইচ.ডি উপাধির জন্যে অনুমোদিত গবেষণা গ্রন্থ এটি। ইংরেজ-আমলের বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করেছেন। এই গ্রন্থ সম্পর্কে ড. নীহার রঞ্জন রায় বলেছেন, ‘পান্ডুলিপিটি পড়ে আমি তরুণ গবেষকের শ্রম, নিষ্ঠা ও অনুসন্ধিৎসায়, তার তথ্য সংগ্রহের শৃঙ্খলায়, তাঁর তথ্য নির্ভর যুক্তিতে, সর্বোপরি তাঁর স্বচ্ছ মুক্ত বুদ্ধি ও দৃষ্টি ভঙ্গির ঔদার্যে সাতিশয় প্রীত ও বিস্মিত হয়েছিলাম।’
সুবিখ্যাত গবেষক ড. রায় খুব অল্পকথায় পুরো বইটির মর্যাদা তুলে ধরেছেন। লেখকের গবেষণায় ইটের স্তূপের মতো শুধু তথ্য জোড় করা হয় না, তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। সে সময় লেখকদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ নামক অত্যন্ত মূলবান গ্রন্থের সব জায়গায় ড. আনিসুজ্জামানের মুক্ত, স্বচ্ছ দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটেছে। বইটি লিখেছেন ভাষা আন্দোলনের দশকের শেষপাদে-১৯৫৮ সালের মধ্যে আর প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান বিরোধী গণ অভ্যুত্থানের দশকে-১৯৬৪ সালে।
বাঙালি মুসলমানের সার্বিক মনোভূমি বিশ্লেষণ করেছেন ইতিহাস সিদ্ধ তথ্যের ভিত্তিতে। ইংরেজের উস্কানি মূলক, বানোয়াট ইতিহাস পরিহার করেছেন। বলেছেন, ‘এ কালের সামাজিক পটভূমিকা আলোচনা করতে যেয়ে কয়েকটি প্রচলিত মত আমাকে বর্জন করতে হয়েছে। যেমন, হান্টার এবং তাঁর অনুসারীদের ধারনা এই যে, চিরস্থায়ী বনোদবস্তের ফলে মুসলমান জমিদারের জায়গায় হিন্দু জমিদাররা স্থলাভিষিক্ত হন। আমি দেখাবার প্রয়াস পেয়েছি যে, নবাবি আমলে জমিদার বলে যাঁদের আখ্যা দেয়া যেত, তাঁদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। ইংরেজ আমলে পুরোনা জমিদারের বদলে নতুন মজিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়। ....ঘটনাক্রমে নতুন জমিদাররা সকলেই আসেন হিন্দু সমাজ থেকে, কিন্তু পুরোনা যুগেও আধিপত্য ছিলো তাদের।’
এছাড়া ইংরেজরা কেবলই মুসলমানদের প্রতি অবিচার করেছে আর হিন্দুদের উপর সুবিচার করেছে, এমন প্রচলিত বিশ্বাসও তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। এর ভিত্তিহীনতা উন্মোচন করেছেন। কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দেন ইংরেজ বাহাদুর, ইংরেজ সরকার প্রতিষ্ঠিত ১৮০০ সালের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে মুসলমান শিক্ষকরা আরবি-ফার্সি পড়াতেন। তাহলে এক চেটিয়া মুসলিম বিদ্বেষ প্রমাণিত হয় কীভাবে?
এমন মহৎ গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। ইংরেজ আমলে, আধুনিকতার সূচনাকালে এবং তৎপর বাঙালি মুসলমানের মানস, তাদের সাহিত্য, সমাজচিন্তা, ধর্মান্দোলন সব দিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাতে ধরা পড়েছে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তার উত্থান-পতন, দৃষ্টি-ভঙ্গির পশ্চাদপদতা ও অগ্রগামিতা। পারিপার্শ্বিক প্রভাবে, ইতিহাসের অমোঘ গতিতে বাঙালি মুসলমানও পায়ে পায়ে সামনের দিকে, আধুনিকতার ও ইতজাদতিকতার দিকে এগিয়ে গেছে। এর নান্দনিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন ড. আনিসুজ্জামান। আজকের দিনে তাঁর উজ্জ্বল পরমায়ু কামনা করি।


মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।

সাম্প্রতিক