কামাল লোহানী
বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যে তুলকালাম কা- ঘটিয়েছিল তা ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফল- কানাডার আদালতে বিষয়টি খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে তাই প্রমাণিত হলো। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত ছিল কিনা এ নিয়ে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটল এবং যারা বাংলাদেশ ও আমাদের সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান করতে অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল তারা যথাযথ কিংবা সমুচিত জবাবও পেল ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ কানাডার আদালতে খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এর দায়টা নেবে কে? বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ ব্যাপারে এখন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে পরবর্তী যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়া।
বিশ্বব্যাংক ‘দুর্নীতির’ প্রসঙ্গ তুলে দেশের বৃহৎ এই প্রকল্পটি থেকে সরে গেল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরু করে যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে তা অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপের দাবিদার হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিশ্বব্যাংক এবং আমাদের দেশের কতিপয় হীনস্বার্থবাদী দেশের ভাবমূর্তিতে প্রশ্নচিহ্ন যুক্ত করে দিয়েছিল। ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন প্রায় দু’ বছর তদন্ত, অনুসন্ধান ও অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েছিল অভিযোগটি অমূলক।
কানাডার আদালতে মামলাটি খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে এও প্রমাণিত হলো, আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের এ ব্যাপারে সব কার্যক্রম অনুসন্ধান সঠিক ছিল। কানাডার আদালত বিষয়টিকে গালগল্প হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের তরফে অভিযোগ উত্থাপনের পর আমাদের ভাবমূর্তিই যে কেবল প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল তাই নয়, একই সঙ্গে এ ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতা ও প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টিও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্বপ্নের প্রকল্প পদ্মা সেতুর কাজ এতসব প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকার ইতোমধ্যে যথেষ্ট এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে এবং আশা করা যায়, এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন মোটেও এখন আমাদের কাছে দুরূহ নয়। আমরা এখন সঙ্গতই আশা করতে পারি যে, প্রত্যাশিত কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি স্থল যোগযোগ স্থাপনের স্বপ্নপূরণ হবে।
এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সরকার বিশ্বদরবারে আমাদের রাষ্ট্রকে উচ্চস্থানে নিয়ে যেতেও সক্ষম হয়েছে। আমরা অনেকেই ভুলে যাইনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই কথা, যে কথা তিনি বলেছিলেন জাজিরায় নদীশাসন কাজ উদ্বোধনের পর। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম আমরা যে পারি তা দেখাব। আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।’ আমরা এও দেখেছি বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর দেশের সাধারণ মানুষও শেখ হাসিনা সরকারকে দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে এ প্রকল্পের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিলে অর্থ জমা দিয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রকল্পে পরিমাণগত দিক থেকে এই অর্থ খুব বেশি নয় তা সত্য কিন্তু এর তাৎপর্য যে বিশাল এ বিষয়টি অস্বীকারের অবকাশ নেই। শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, যারা আমাদের দেশের দুর্নীতির এই অভিযোগে রাজনৈতিক অঙ্গনে অপরাজনীতির রং মিশিয়ে সরকার ও ব্যক্তিকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেও এখন আইনের আশ্রয় নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। বিদেশের একটি আদালতে অভিযোগটি অমূলক-মিথ্যা গালগল্প হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক এবং এ দেশের কুচক্রীরা এখন কী বলবে? কানাডার আদালতের রায়ের পর বিএনপি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তাও কি নিন্দনীয় নয়? দেশের এত বড় অর্জনে তাদের কাছে এমন ভূমিকা পুনর্বার স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দেশপ্রেম নিয়েই এখন আবার জোরেশোরে প্রশ্ন তোলা যায়। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠ চিত্তে পুনর্বার অভিনন্দন জানাই তার দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সাহসিকতার জন্য। এই লড়াইয়ে তিনি পিছপা হননি। সত্যের জয় এভাবেই পরিস্ফুটিত হয় তা দুর্মখেরা আবার জেনে নিক।
আমাদের ব্যাপক আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নির্মিত পদ্মা সেতু প্রকল্প শুধু দেশের যোগাযোগ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয়, ভাবমূর্তির ক্ষেত্রেও হয়ে থাকবে মাইলফলক হয়ে। প্রমত্ত পদ্মার বুকে আমাদের সামর্থ্যরে মাপকাঠি অনুযায়ী যে কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হতে যাচ্ছে তা বিশাল এবং ব্যাপক। এই সেতু আমাদের গৌরবের প্রান্তর। আমাদের সরকারের সাহসী পদক্ষেপের ফসল এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাসীকে আমরা এও দেখিয়ে দিতে পেরেছি যে, আমরাও পারি। বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের সঙ্গে পদ্মা সেতুসংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করে দিয়েছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ পত্রিকান্তরে দেখলাম, বিশ্বব্যাংক নাকি অতীত ভুলে এখন সামনের দিকে এগোতে চায়। কী বিস্ময়কর স্ববিরোধিতা। তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে এই প্রকল্প থেকে সরে গিয়ে যে প্রচ- আঘাত করেছিল এর সঙ্গে আমাদের এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও সরকারের অনেক কিছু জড়িত। এখন তারা অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক অতীত ভুলে গিয়ে সামনের দিকে এগোতে চাইলেই কি আমাদের ওপর আঘাতের যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তা শুকিয়ে যাবে? আগে এর প্রতিবিধান হোক। তারা তাদের ভুল ‘স্বীকার’ করুক। ক্ষতিপূরণ দিক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালক, নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট অনেককেই তারা অসাধু বানাতে চেয়েছিল। আর এতে ইন্ধন জুগিয়েছিল দেশের কতিপয় হীনস্বার্থবাদী। এসবের প্রতিকার ভবিষ্যতের জন্য জরুরি।
বিশ্বব্যাংকে তৎকালীন বাংলাদেশ প্রধান, কয়েকটি গণমাধ্যম ও টকশোর কিছু চেনামুখ ‘এত বড় দুর্নীতির’ জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ যাদের হেনস্থা করেছিল, তুলাধুনা করেছিল, সম্মানের হানি ঘটিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা এখন সরকারের নেয়া উচিত বলে মনে করি। সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল এবং একজন সচিব ও একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল এবং তাদের কাউকে কাউকে করতে হয়েছিল কারাবাস। জননিন্দার কারণে সরকার এমনটি করতে বাধ্য হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, বিশ্বব্যাংকের মতো একটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান কেন এমন অন্যায় আচরণ করেছিল? কী রহস্য ছিল এর পেছনে? যে বা যাদের মধ্যে নূন্যতম দেশপ্রেমবোধ আছে তারা বিশ্বব্যাংক এবং আমাদের হীনস্বার্থবাদীদের এমন আচরণ মেনে নিতে পারে না আর এখন তো বিষয়টি হজম করে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। স্থানীয় যারা সেদিন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে দেশ-ব্যক্তি-সরকারের ললাটে কলঙ্কতিলক এঁকেছিলেন তাদের ব্যাপারে এখন কী করা যায় তা সরকারের দ্রুততার সঙ্গে ভাবা কর্তব্য। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হতে পারে এজন্য এর বিকল্প নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই বলেছিলেন এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। তার কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কানাডার আদালতে মামলার এ সংক্রান্ত রায়ে আরো পরিষ্কার হলো যে, বিশ্বব্যাংক যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত দাবি করেছিল তাও ছিল বড় ধরনের কূটকৌশল। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই তারা যা যা করেছে সেসবই চরম নিন্দনীয়। এখন কী বলবে বিশ্বব্যাংক? যদি বলি পদ্মায় ডুবল বিশ্বব্যাংক তাহলে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না। যা হোক আমরা কালিমামুক্ত হলাম, এখন কালিমালিপ্ত হলো বিশ্বব্যাংক। এই অভিযোগের কারণে যারা চাকরি হারিয়েছেন পদচ্যুত হয়েছেন তাদের এখন স্বপদে পুনর্বহাল করার দরকার বলে মনে করি। এই অপক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারি।
লেখক: প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
Next > |
---|