স্টাফ রিপোর্টার: দেশের বড় বড় ভোজ্যতেল রিফাইনারিগুলো চট্টগ্রাম অঞ্চলে নদী ও সমুদ্র দূষণ ঘটাচ্ছে। নির্দেশনা থাকলেও ওসব রিফাইনারি বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) না বসিয়ে তা ফেলছে নদী ও সাগরে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে পতেঙ্গা এলাকায় স্থাপিত ওই বড় রিফাইনারিগুলোর বর্জ্যে নদী ও সমুদ্র দূষণের ঘটনা ঘটছে। অথচ ওসব প্রতিষ্ঠানকেই টিপিপি স্থাপনে বেঁধে দেয়া সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখনো তা কার্যকর করা হয়নি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী পরিশোধনের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য সহনীয় মাত্রায় এনে কোনো কারখানা থেকে বর্জ্য নিঃসরণ করা যায়। কিন্তু বড় বড় ভোজ্যতেল রিফাইনারিগুলো তা না করায় রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলীসহ আশপাশের জলাশয়গুলোয় মিশছে। ওসব অপদ্রব্য দীর্ঘমেয়াদে জলজ বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশবাসী ও পরিবেশ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বড় বড় রিফাইনারিগুলো অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানির পর তা পরিশোধন করেই বাজারজাত করে। সেক্ষেত্রে রিফাইনারিগুলোয় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ওই নির্দেশনা সত্ত্বেও ইটিপি ছাড়াই চলছে সিটি গ্রুপ টিকে গ্রুপ ও এমইবি গ্রুপের তিন রিফাইনারি। বিগত ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের পূর্ব পতেঙ্গা এলাকার টিকে গ্রুপের মালিকানাধীন বে-ফিশিং অয়েল রিফাইনারি, উত্তর পতেঙ্গায় মেসার্স ইলিয়াস ব্রাদার্সের মালিকানাধীন এমইবি অয়েল রিফাইনারি ইউনিট-২, একই এলাকায় সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন ভ্যান ওমারেন ট্যাংক টার্মিনাল (ভিওটিটি) অয়েল রিফাইনারিতে অভিযান চালানো হয়। তাতে ইটিপিহীন ওসব রিফাইনারির বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। কর্ণফুলী নদীতীরবর্তী ওই তিন রিফাইনারির দৈনিক ভোজ্যতেল পরিশোধনের ক্ষমতা প্রায় ১ হাজার ৫০০ টন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইটিপি ছাড়াই ভোজ্যতেল পরিশোধন করে আসছে। ওই অবস্থায় পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৫ সালের শুরুতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইটিপি স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু ওই নির্দেশনা অমান্য করায় ২০১৬ সালের জুনে তিন রিফাইনারিকে জরিমানাও করা হয়। পাশাপাশি একই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো ইটিপি স্থাপন করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
সূত্র জানায়, রিফাইনারিগুলোতে আমদানিকৃত অপরিশোধিত ভোজ্যতেল পরিশোধন করে বোতলজাত করা হয়। আর পরিশোধনকালেই ফ্যাটি অ্যাসিডজাতীয় বর্জ্য তৈরি হয়। টনপ্রতি অপরিশোধিত ভোজ্যতেলে তার পরিমাণ প্রায় ২ থেকে ৩ শতাংশ। তার সিংহভাগই সাবান তৈরির কারখানায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু ইটিপি না থাকায় তরল বর্জ্যরে সাথে মিশে থাকে ওই তেলজাতীয় জৈব পদার্থ কর্ণফুলী নদীসহ আশপাশের খাল ও নর্দমায় গিয়ে পড়ছে। তার সাথে বিভিন্ন রাসায়নিক অপদ্রব্যও মিশ্রিত থাকে। তাতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদেরও জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
এদিকে ভোজ্যতেল রিফাইনারিগুলোর বর্জ্য প্রসঙ্গে পরিবেশবিদদের অভিমত, ভোজ্যতেল রিফাইনারির বর্জ্য সরাসরি পরিবেশের ক্ষতি না করলেও নদী, খাল-বিল ছাড়াও জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট করে। পানির সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে ক্ষুদ্র অণুজীবের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নষ্ট করে দেয়। তাতে জলজ প্রাণিকুল ধীরে ধীরে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। ইটিপি স্থাপনের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের অপদ্রব্য সরাসরি নদীতে নিঃসরণ রোধ করতে না পারলে কর্ণফুলী নদীর দূষণ আরো মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছবে।
অন্যদিকে ইটিপি প্রসঙ্গে বে-ফিশিং রিফাইনারির ডিজিএম মো. ইকবাল জানান, ২০০১ সালে বে-ফিশিং রিফাইনারি চালু হয়। কারখানায় পুরনো ইটিপি থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আধুনিক ইটিপি স্থাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশমতো কাজও শুরু করা হয়েছে। আশা করা যায় আগামী মাসের মধ্যে নতুন করে পরিবেশের লাইসেন্স নবায়ন করা যাবে। আর ভিওটিটি রিফাইনারির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল হান্নান জানান, প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ইটিপি স্থাপনের বাধ্যবাধকতা ছিল না। বর্তমানে ইটিপি বাস্তবায়নের জন্য জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। তারপরও পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ইটিপি স্থাপনের প্রাথমিক সিভিল ওয়ার্ক শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে না পারলেও আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ইটিপি প্লান্ট স্থাপনের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার তিনটি বড় ভোজ্যতেল রিফাইনারিতে ইটিপি না থাকা প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মহানগর) আজাদুর রহমান মল্লিক বণিক জানান, ভোজ্যতেল রিফাইনারিতে ইটিপি স্থাপনের বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর তৎপর রয়েছে। সেজন্য তিন রিফাইনারি কর্তৃপক্ষকেই কয়েক দফা তাগাদা দেয়া হয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানই ইটিপি স্থাপন করেনি। সেজন্য প্রতিটি রিফাইনারিকে ইটিপি স্থাপন না করা পর্যন্ত দৈনিক ভিত্তিতে জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
Â
< Prev | Next > |
---|