স্টাফ রিপোর্টার: উচ্চ আদালতে দীর্ঘদিন ধরেই হাজার হাজার রাজস্ব মামলা ঝুলে আছে। তাতে সরকারের আটকে আছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। মামলা নিষ্পত্তিতে প্রশাসনের গা-ছাড়া ভাবে হতাশ করদাতারা। গত ১০ মাস যাবৎ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) কোনো আইন কর্মকর্তা নেই। ফলে ওসব মামলার কোনো তদারকিই হচ্ছে না। দেশের উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকা রাজস্ব মামলা সমন্বয়ের অভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এতে এদিকে যেমন মামলা নিষ্পত্তিতে বাড়ছে দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত জুলাই পর্যন্ত দেশে সর্বমোট ২১ হাজার ৪৪৪টি রাজস্ব মামলা উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে। ওসব মামলার বিপরীতে সরকারের পাওনা ১৯ হাজার ১৬ কোটি টাকা। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা কাস্টমসের। বর্তমানে ১১ হাজার ৮৮৭টি মামলাই কাস্টমস-সংক্রান্ত। তারপরই আছে ৬ হাজার ২৩টি আয়কর ও ৩ হাজার ৫০৪টি মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটসংক্রান্ত মামলা। অভিযোগ রয়েছে, এনবিআরের ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা বিচারক হওয়াতেই রাজস্ব মামলা বাড়ছে। আবার কর্মকর্তাদের অসতর্কতা ও ইচ্ছাকৃত নানাবিধ কারণেও মামলা হচ্ছে বা বাড়ছে। তবে মামলার ক্লাসিফিকেশন করে জট কমানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে একটা মামলা সমাধান হলেই কয়েকশ মামলা নিষ্পত্তি হবে। দেশের উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা রাজস্ব মামলার কারণে সরকার যেমন বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঝুলে থাকা রাজস্ব মামলার অধিকাংশেরই ব্যাংক গ্যারান্টি ও নথি ব্যবস্থাপনাও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে।
সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে চলমান রাজস্ব মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার মূল কারণ হচ্ছে সমন্বয়ের অভাব। তবে আদালতের সাথে এনবিআরের অধীন দফতরগুলোর যথাযথ সময়ানুগ সংযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। তার আগে ২০১৫ সালে জটবদ্ধ রাজস্ব আদায় ও মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রাধিকার ভিত্তিতে ৮টি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। এনবিআরের পক্ষ থেকে ওই চিঠিতে ‘করণীয়’ বলা হয়- অন্তর্বতীকালীন আদেশ প্রদত্ত হাই কোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ‘অধিক রাজস্ব জড়িত’ রিট মামলাগুলোকে কজলিস্টভুক্ত করে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ। এনালোগাস ও অনিষ্পন্ন কয়েক হাজার মামলার তালিকা করে ডেপুটি সলিসিটরদের (রিট) কাছে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী ওসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্টদের নিবিড়ভাবে সম্পৃক্তকরণ। আদালতে মামলার সূচনালগ্নে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞদের সঙ্গে কাস্টমসের একজন প্রতিনিধির অবস্থান ও বক্তব্য প্রদান নিশ্চিতকরণ। বিচারকদের কাস্টমসের প্রায়োগিক, আইনি, কারিগরি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক অবহিত করা গেলে ‘প্রিম্যাচুরড মামলা’ উপেক্ষিত হবে। তাতে মামলা দায়েরের প্রবণতা কমবে। মেরিটহীন মামলা সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ সীমিত হবে। হাইকোর্ট বিভাগে সরকার পরাজিত মামলায় আপিল দায়ের ও এনবিআরের মামলা মনিটরিংয়ের জন্য একাধিক অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড (এওআর) নিয়োগ ও নির্দিষ্টকরণ। কেননা যথাসময়ে আপিল দায়ের না হলে নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলে প্রতিপক্ষ মামলায় কনটেম্পটের উদ্যোগ নেয়। কাস্টমস ও ভ্যাটের মামলা বিচারের লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের জন্য একই প্রকৃতির মামলার জন্য এক বা একাধিক পৃথক আদালতে ন্যস্ত রাখা। কেননা আদালত পরিবর্তন হলে পিটিশনাররা বিজ্ঞ আদালতকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নিয়ে রায় নিজেদের পক্ষে নেন। এনবিআরের মামলার জন্য নির্দিষ্ট ৬টি বেঞ্জের প্রতিটির জন্য অন্তত একজন সার্বক্ষণিক নিয়োজিতকরণ, যাতে একজন ছুটিতে বা অন্যত্র ব্যস্ত থাকলে অন্যজন শুনানিতে উপস্থিত থাকতে পারেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বেঞ্চ থেকে রায় ঘোষিত ও ঘোষিতব্য মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি উত্তোলন ও এ-সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য একজনকে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা। ওই পত্রে আরো হয়, বিরাজমান মামলার জট খুলে দিতে প্রাইভেট রিটেইনারের দরকার হবে না। পাশাপাশি উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারলে মামলাজটও কমবে। মামলা দায়েরের প্রবণতা কমবে। রিট মামলা দায়েরর ক্রমবর্ধমানতা রোধ হবে। মামলাজটে আটকে থাকা রাজস্বের একটা বৃহদাংশ স্বল্পতম সময়ে আদায় সম্ভব হবে।
এদিকে আদালতে আটকে থাকা রাজস্ব মামলা প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জানান, ব্যবসায়ীরা মামলাজট থেকে বের হতে চান। কিন্তু এনবিআর মামলার জট খুলতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) আজও কার্যকর করতে পারেনি। কর ন্যায়পালও কার্যকর নেই। মামলার জট বন্ধে কাস্টমস আইন যুগোপযোগী করতে হবে। এর সাথে সব অংশীজনের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান দরকার।
< Prev | Next > |
---|