স্টাফ রিপোর্টার: দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা (এসএমই) খাতে উদ্যোক্তার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যদিও গুরুত্ব বিবেচনায় ওই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এসএমই খাত এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩০-৩৫ শতাংশই জোগান দিচ্ছে এই খাত। আর গুরুত্ব বিবেচনায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এসএমই খাত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বিগত ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাতটিতে ঋণপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৭৯২। অথচ ২০১৬ সালের একই সময়ে এসে ওই খাতে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেমে এসেছে ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫১১তে। ওই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খাতটিতে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ১ লাখ ১১ হাজার ২৮১টি। যদিও ওই সময়ে এসএমই খাতে মোট ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৯ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৬ সালে দেশে এসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। দেশের ৫৬টি ব্যাংক ও ৩১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোট ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫১১ জন উদ্যোক্তার মধ্যে ওই ঋণ বিতরণের লক্ষ্য স্থির করা হয়। আর আগের বছরের তুলনায় ওই সময় ঋণ বিতরণের লক্ষ্য বাড়ানো হয়েছিল ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তার মধ্যে এসএমই সেবা খাতে গতবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি। ওই হিসাবে এসএমই খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। একই সময়ে এসএমই ব্যবসা খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৪ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই সময়ে এসএমই ব্যবসা খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ২৩ শতাংশের বেশি।
সূত্র জানায়, এসএমই সেবা ও ব্যবসা খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়লেও গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিল্প খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ হয়েছে ২৫ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। আগের বছরের ৯ মাসে ওই খাতে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৩৮৮। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা নেমে এসেছে ৪৭ হাজার ১৫৪টিতে। অর্থাৎ ওই সময়ে এসএমই শিল্প খাতে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৭৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। একই সাথে কমেছে নারী উদ্যোক্তাদের গড়ে তোলা শিল্প ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণও। ২০১৫ সালে ওই খাতে ১ হাজার ৬৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হলেও গত বছর করা হয়েছে মাত্র ৮৮৩ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, এসএমই খাতে বিগত ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো লক্ষ্যের ৮৯ দশমিক ১৫ শতাংশ ঋণই বিতরণ করেছে। তার মধ্যে কিছু ব্যাংক লক্ষ্যের তুলনায় দুই-তিন গুণ বিতরণ করলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ বিতরণে ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশই। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এসএমই খাতে ঋণ বিতরণে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। ২০১৬ সালে ব্যাংকটির ৫৯৩ জন উদ্যোক্তাকে ৩০০ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্য থাকলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হয় মাত্র ৫০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যের ১৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। তাছাড়া ২০১৬ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়সীমায় রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক লক্ষ্যের ৪৫ দশমিক ১১ শতাংশ, বেসিক ৪৬ দশমিক ৪৫, সোনালী ৫৪ দশমিক ৮৬, কৃষি ৫০ দশমিক ৫৪ ও জনতা ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ৬২ দশমিক ৯১ শতাংশ এসএমই ঋণ বিতরণ করতে পেরেছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো ২০১৬ সালে মোট ৩ লাখ ৬১ হাজার ১১৪ জন উদ্যোক্তার মধ্যে ৯১ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য গ্রহণ করেছিল। আর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে লক্ষ্যের ৯৫ শতাংশ বা ৮৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। ওই সময়ে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক লক্ষ্যের তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণ করলেও কোনো কোনোটি তা প্রত্যাশিত হারে বিতরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার মধ্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল ২০১৬ সালে ৪৭৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা। যদিও ওই ৯ মাসে ব্যাংকটি বিতরণ করেছে মাত্র ১৬০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যের ৩৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। একই সময়ে এসএমই খাতে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লক্ষ্যের ৪৯ শতাংশ, পূবালী ৬০, আইএফআইসি ৬১ ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৬৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। আর ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩১টি গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ঋণ দিয়েছে ২১ হাজার ৫১৭ জন উদ্যোক্তাকে। মোট বিতরণের পরিমাণ ৪ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে গত বছরের মোট বিতরণ লক্ষ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ।
এদিকে দেশের এসএমই খাতে ঋণ বিতরণের হিসাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে সংশ্লিষ্ট এসএমই উদ্যোক্তারা। জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশের (নাসিব) সহ-সভাপতি ইফতেখার আলী বাবু এ প্রসঙ্গে জানান, ব্যাংকগুলো এসএমই খাতে বিতরণের নাম করে ঋণ দিচ্ছে অন্য সেবা ও ব্যবসা খাতগুলোয়। অথচ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো ঋণের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো শুধুমাত্র নিজেদের ব্যবসার কথা বিবেচনা করছে। দেশের এসএমই খাতে ঋণের যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে সেই পরিমাণ অর্থ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে তা সত্যি সত্যি বিনিয়োগ করা হলে দেশের চেহারাই পাল্টে যেত।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জানান, এসএমই শিল্প খাতে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হ্রাসের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে রয়েছে। ২০১৬ সালে এসএমই সেবা ও ব্যবসা খাতে ঋণপ্রবাহ অনেক বেড়েছে। সে তুলনায় এসএমই শিল্পে ঋণপ্রবাহ বাড়েনি। সেবা ও ব্যবসা খাতে কমিয়ে শিল্প খাতে ঋণ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোর প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
< Prev | Next > |
---|