3sfsgস্টাফ রিপোর্টার : আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে দেশের বনভূমির পরিমাণ। মূলত সমন্বিত উদ্যোগের অভাবেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অথচ পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের মোট ভূখ-ের প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এদেশে সেই পরিমাণ বনভূমি নেই। বরং বিগত ২৫ বছরে দেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে গেছে। তারপরও বনাঞ্চল রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নেই। ফলে ধ্বংসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশে বিদ্যমান প্রাকৃতিক বনের প্রায় ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশই। বন অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে এদেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মধ্যে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা সুন্দরবন ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলোই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। শালবনের ১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ১৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত আছে। অর্থাৎ শালবনের মাত্র ১৫ শতাংশ এখন বিদ্যমান আছে। তাছাড়া দেশে ৭ লাখ হেক্টর পার্বত্য বনাঞ্চলের মধ্যেও মাত্র এক লাখ হেক্টর বর্তমানে প্রাকৃতিক বন দ্বারা আচ্ছাদিত। অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি বনের মাত্র ১৪ শতাংশ টিকে আছে। অথচ ১৯৯০ সালেও দেশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছিল ৪ লাখ ১ হাজার হেক্টর। কিনতু ২০০০ সালে তা ৩ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর এবং ২০০৫ সালে ৩ লাখ ৯৫ হাজার হেক্টরে নেমে আসে। প্রাকৃতিক ওই বনজ ব্যবস্থা সংকোচনের ধারাবাহিকতা ২০১৫ সালেও দেখা গেছে। ২০১৫ সালে ম্যানগ্রোভ বনের আয়তন ৩ লাখ ৯০ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। আর শালবনের আয়তন ১৯৯০ সালে ২৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর থাকলেও ২০০০ সালে তা ২১ হাজার ৯৯০ হেক্টর এবং ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৯০ হেক্টরে নেমে আসে। একইভাবে পার্বত্য বন ১৯৯০ সালে ১ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর থাকলেও ২০১৫ সাল নাগাদ তা ৭৯ হাজার ১৬০ হেক্টরে নেমে আসে। ২৫ বছরে পার্বত্য বন কমেছে ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর। মূলত মানবসৃষ্ট কারণের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সুন্দরবনসহ দেশের বনভূমির জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বসতি স্থানান্তর ও অন্যান্য কারণে মাটি ও পাহাড়ের ওপর চাপ বাড়ছে। পাশাপাশি ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি ও শীতকালে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ৩ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ওই সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়বে ২ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত।

সূত্র জানায়, বিগত ২৫ বছরে সুন্দরবন কমেছে ১০ হাজার ৯৮০ হেক্টর। একই সময়ে শালবন ৬ হাজার ১৬০ হেক্টর এবং পার্বত্য বনাঞ্চল ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর কমেছে। একইভাবে বাঁশবাগান কমেছে ৭৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর। তারপরও বর্তমানে দেশে যে বনাঞ্চল রয়েছে সেগুলোও ধ্বংসের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যমান বনাঞ্চল রক্ষা করা ছাড়াও ৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজন। সেজন্য দরকার ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে জনবল সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের অনুপস্থিতির কারণে বনভূমি রক্ষায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি বন বিভাগের অদক্ষতা, জনসচেতনতার অভাব এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞার কারণেও দেশের বনাঞ্চল ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশের বনাঞ্চল কমার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনও ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক দশকে ঝড়, বন্যা ও অতিবর্ষণের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে যে ভাঙন হয়েছে বনাঞ্চলে তার নানামুখী প্রভাব পড়েছে। জীবিকা, আবাসনসহ নানা প্রয়োজনে বনভূমিতে মানুষের নির্ভরতা ও চাপ বাড়ছে। বনাঞ্চল হ্রাসের এমন ধারা ঠেকানোর পাশাপাশি নতুন বন সৃজন করতে না পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়বে দেশ। বাড়বে উষ্ণতা। পরিবর্তিত হবে ঋতুচক্র। বিঘিœত হবে বাস্তুব্যবস্থার ছন্দ। ফলে সরাসরি প্রভাব পড়বে শস্য আবাদ ও জনজীবনে। তাতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘিœত হবে।

সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে দেশে সুন্দরবন ছাড়া আর কোনো প্রাকৃতিক বনাঞ্চল নেই বললেই চলে। বন অধিদফতরে সুশাসন ও দক্ষতার অভাবের কারণে বনাঞ্চল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বনাঞ্চল রক্ষায় গৃহীত কার্যক্রম জোরদার এবং সামাজিক বনায়নে মালিকানার বিষয়টি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি বনাঞ্চল রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছাও সবচেয়ে বেশি দরকার। সে লক্ষ্যে আইন, নীতিমালা, জনবল ও উপযুক্ত উপকরণের সমন্বয়ে বন অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এক গবেষণায় দেশের প্রাকৃতিক ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংসের ১০টি ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে বনাঞ্চল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আইনি ও নীতিসহায়তা এবং অর্থ বরাদ্দে অপর্যাপ্ততার কথা হয়। তাছাড়া বিধি ও আইনবহির্ভূতভাবে গাছ কাটা, বাজারে অবৈধভাবে কাঠ বিক্রি, স্থানীয় সম্প্রদায় দ্বারা অ-টেকসই ও অবৈজ্ঞানিকভাবে বনজ সম্পদ আহরণও বনাঞ্চল ধ্বংসে দায়ি। পাশাপাশি শিল্প ও আবাসন ব্যবসায়ীদের কর্মকা- সম্প্রসারণ এবং জমি দখলকারীদের প্রভাবের কারণে বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া স্থানীয় জনগণের অসহযোগিতাও বনাঞ্চল সংরক্ষণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের ঝুঁকি হিসেবে বিভিন্ন আইনি কাঠামো প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে অপ্রয়োজনীয় কালক্ষেপণকেও গবেষকরা দায়ি করেছেন। আর ক্রমাগত ও ধারাবাহিক বনাঞ্চল ধ্বংসে হুমকিতে রয়েছে দেশের জীববৈচিত্র্য। বিলুপ্তির পথে রয়েছে দেশের বনাঞ্চলের ৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪১ প্রজাতির পাখি, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জানান, জনসংখ্যার তুলনায় দেশে জমি কম থাকায় প্রয়োজনীয় বন সংরক্ষণে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। সারা বিশ্বে যেখানে বনাঞ্চল কমছে, সেখানে বর্তমান সরকার ৪ শতাংশ বনাঞ্চল বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং বনাঞ্চল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন করতে পর্যাপ্ত অর্থায়নের প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে। আর সরকারের কর্মকা-ে জনগণ উৎসাহিত হয়েছে বিধায় মানুষের ভেতরে বন রক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও উৎসাহ তৈরি হয়েছে। সেটি কাজে লাগিয়েই বন রক্ষায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।

সাম্প্রতিক