আর্ন্তজাতিক ডেস্ক : গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র লড়াইয়ের কারণে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চল থেকে পালাচ্ছে হাজার হাজার বেসামরিক রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধরা। গতকাল সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওই এলাকাটিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী ও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া লড়াইয়ে এ পর্যন্ত ১০৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় ওই এলাকা থেকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি ত্রাণ সংস্থার কর্মীরাও সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
শুক্রবার রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা লাঠি, ছুরি ও ঘরে তৈরি বোমা নিয়ে ওই এলাকায় পুলিশের ৩০টি চৌকি ও সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়। তারপর থেকে দুপক্ষের মধ্যে শুরু হওয়া লড়াই তিনদিন পরও অব্যাহত আছে।
সামরিক বাহিনীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত রোববার রাখাইনের উত্তরাঞ্চলজুড়ে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে কয়েকশত রোহিঙ্গা বিদ্রোহী অংশ নিয়েছে। গতকাল সোমবার স্থানীয় একটি প্রধান শহরের উল্লেখ করে রাষ্ট্র পরিচালিত দৈনিক গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা ঘরে তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়েছে, মংডুর পুলিশ চৌকিগুলোতে হামলা চালিয়েছে। সরকার ১০৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে। এদের মধ্যে ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও কয়েকজন বেসামরিক রয়েছেন বলে জানিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য রোহিঙ্গা বেসামরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার, বিদ্রোহীদের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নাই তাদের কোনো ধরনের ক্ষতি করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সরকার আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (এআরএসএ) সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে। এই গোষ্ঠীটিই শুক্রবারের হামলায় দায় স্বীকার করেছে। সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে এআরএসএ মিয়ানমার সরকারে দাবিকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছে, তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার জন্য হামলাটি চালিয়েছে বলে দাবি করেছে।
রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দাই রোহিঙ্গা মুসলিম। সরকার জানিয়েছে, সেখান থেকে কয়েক হাজার অমুসলিম বাসিন্দাকে সরিয়ে নিয়েছে তারা। ওই এলাকার অমুসলিম বাসিন্দাদের অনেকে ছুরি ও লাঠি নিয়ে চলাফেরা করছে।
রাজ্যটির রাজধানী সিত্তুয়িতে পালিয়ে আসা ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, “আমরা তাদের তলোয়ারকে ভয় পাই, কারণ তারা তলোয়ার নিয়ে লোকজনকে হামলা করে।”
এর আগে অক্টোবরে পুলিশের একটি চৌকিতে একই ধরনের কিন্তু তুলনায় অনেক ছোট একটি হামলা চালিয়েছিল রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ওই এলাকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমনমূলক সামরিক অভিযান চালিয়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অভিযানকালে তারা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন করেছে বলে ব্যাপক অভিযোগ ওঠে।
একটি ত্রাণ সংস্থার সদস্যরা চলতি অগাস্টে একটি গ্রামের রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কথিত অবরোধের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। সরকার এই কথা জানানোর পর রাখাইনের ওই এলাকা থেকে নিজেদের কিছু কর্মীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে জাতিসংঘ ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা।
রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নি ফু বলেছেন, “এ ধরনের পরিস্থিতিতে কেউ পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।”
এর আগে ত্রাণ সংস্থাগুলোর কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাষ্ট্রই নিশ্চিত করে আসছিল।
“তারা যদি থাকতে চায়, আমরা নিরাপত্তা দেওয়া সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে তারা যদি থাকতে না চান, চলে যেতে চান, আমরা তাদের সাহায্য করবো বলে জানিয়েছি,” বলেছেন নি ফু।
বৌদ্ধ প্রধান মিয়ানমারের প্রায় ১১ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গার বিষয়টি দেশটির জাতীয় নেত্রী অং সাঙ সুচির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী এই নেত্রী রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার নিন্দা করে নিরাপত্তা বাহিনীর পদক্ষেপের প্রসংশা করেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা না বলে তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নেওয়া পাল্টা হামলার পক্ষে কথা বলায় অনেক পশ্চিমা সমালোচক সুচির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন।
এবারের ঘটনার পর কয়েক হাজার রোহিঙ্গা, যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী, রাখাইন থেকে পালিয়ে আন্তর্জাতিক নদী নাফ ও স্থল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে আশ্রয় নিয়েছে। শুক্রবারের পর থেকে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সীমান্তে কাছে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ আশ্রয় নেওয়া প্রাণভয়ে ভীত এসব মানুষকে লক্ষ্য করেও মিয়ানমারের দিক থেকে গুলি করা হচ্ছে। শনি ও রোববার, দুদিনই সীমান্তে গুলির শব্দ শুনেছেন বলে জানিয়েছেন রয়টার্সের প্রতিনিধি।
বহু বছর ধরে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম এ অঞ্চলটিতে রোহিঙ্গারা জাতিবিদ্বেষী পরিবেশে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
< Prev | Next > |
---|