4dffdhgjসালাম সালেহ উদদীন

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের হতে হবে মানবিক এবং সেবার মানসিকতা আমাদের মধ্যে থাকতে হবে। বন্যাদুর্গত এলাকার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার মানবিক কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনে যদি আমরা উদাসীন থাকি, তা হলে উৎকৃষ্ট মানুষের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই।
দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যাকবলিত। বন্যাকবলিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছু অংশও। ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এই বন্যা পরিস্থিতি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্যানুযায়ী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাঙামাটি, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, কুমিল্লা, শেরপুর নাটোর ও ঢাকা জেলা এখন বন্যাকবলিত। বন্যায় আক্রান্ত ভারত, নেপাল ও চীনের বিভিন্ন রাজ্যও। সেখানকার নদ-নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। যে কারণে তারা তাদের অতিরিক্তি পানি ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে।

সরকারি হিসাবেই বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১২১ জনে দাঁড়িয়েছে। মৌসুমের দ্বিতীয় দফা বন্যাকবলিত হয়েছে ৩১ জেলার ১৭৬টি উপজেলার ৪৪টি পৌরসভা ও ১৩১৭টি ইউনিয়ন। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৬১ লাখ ২৩ হাজার ৯৫৪ জন। যার মধ্যে পানিতে ডুবে মারা গেছে ৯২ জন। আক্রান্ত জেলার সড়ক ও রেললাইন ডুবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষ নিজেদের উদ্যোগে রেললাইন মেরামত করেছে অবশেষে ৩৬ ঘণ্টা পরে দেশের উত্তর দক্ষিণের ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ মানুষ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উপদ্রুত এলাকার মানুষ সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। সারা দেশে ৬৩০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৯০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অনেক এলাকায় আশ্রয় নেয়ার মতোও জায়গাও নেই। তাই কারও কারও আশ্রয় হয়েছে ঘরের চালা ও মাচায়। বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রবীণদের অবস্থা বড়ই করুণ। অনেকেই না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও পদ্মায় পানি বাড়ায় দেশের দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে।
এবারের বন্যায় সরকারিভাবে বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চললেও ত্রাণসামগ্রীর সংকটের চিত্রও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। তবে বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা তেমন জোরদার নয়। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যদি ত্রাণ ও সার্বিক সহায়তা যথাসময়ে না পৌঁছায় তবে দুর্ভোগ আরও বাড়বে। দেখা দেবে মানবিক বিপর্যয়। বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সহায়-সম্বল হারানোর পাশাপাশি তাদের জীবিকার পথও বন্ধ হয়ে যায়। বন্যা প্লাবিত এলাকায় বন্ধ হয়ে গেছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষকের। আমন ক্ষেত, বীজতলা, শাক-সবজির ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা এখন দিশাহারা। বন্যার প্রকোপে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬৪টি পরিবার দুর্গত জেলাগুলোয় ৪৩ হাজার ৩২২টি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৫৬১টি হাঁস-মুরগি মারা গেছে ২৮৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায় ২২৫টি ব্রিজ ও কালভার্টে এবং ১৭০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বন্যা উপদ্রুত এলাকা কুড়িগ্রাম সফর করেছেন। তিনি বলেছেন, 'যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জনগণ যাতে অনাকাক্সিক্ষত সমস্যায় না ভোগে সে জন্য তার সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে'। তিনি আরও বলেছেন নতুন ফসল ওঠা না পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্যসহায়তা দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কথায় আমরা আশাবাদী। তিনি সবসময়ে দেশের গরিব দুস্থদের পাশে রয়েছেন।

বন্যা উপদ্রুত এলাকায় রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। এবারের বন্যায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট বেশ তীব্র। বন্যা দুর্গত এলাকায় শুরু হয়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। সংকট রয়েছে বিশুদ্ধ পানিরও। বন্যার কারণে যে কেবল জনগণের ক্ষতি হবে তা নয়, দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ক্ষতি সাধিত হবে। এমন অবস্থায় বন্যা মোকাবেলায় পূর্ব প্রস্তুতি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি নদীভাঙনও রোধ করতে হবে। কেবল বন্যার কারণেই নয়, নদী ভাঙনের কারণে অনেক মানুষ পথে বসেছে। এ ব্যাপারেও সরকারকে দিতে হবে গভীর মনোযোগ। তৈরি করতে হবে সুষ্ঠু নীতিমালা।

বহু বছর ধরেই বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আমাদের বসবাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। বন্যা পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনে যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নেমে আসে তা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় ধরনের বন্যা হয়েছে তার মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যা বেশ ভয়াবহ। ওই বন্যায় রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকা তলিয়ে গিয়েছিল। অতীতের বন্যায় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, সরকারির ত্রাণের পাশাপাশি বেসরকারি ত্রাণ পর্যাপ্ত ছিল। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী শিক্ষকরা বন্যাকবলিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা রুটি বানিয়ে উপদ্রুত এলাকায় বিলি করেছে। দেশের উচ্চবিত্তরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অবাক ব্যাপার যে এবারের বন্যায় ওই রকম মানবিক দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়েছে। বন্যাদুর্গত জনপদের মানুষকে সহযোগিতা করতে এনজিওসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে দ্রুত এগিয়ে আসা জরুরি।

আসলে মানুষ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অন্যের ভালো দেখা অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর সংস্কৃতিতে যেন বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আগে দেশের তরুণরা মানবকল্যাণে কাজ করত। দেশের যেখানেই মানবিক বিপর্য হয়েছে তারা ছুটে গেছে, পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন আর তেমন দৃশ্য চোখে পড়ছে না। ফলে এবারের বন্যায়ও তাদের উদাসীনতা পীড়াদায়ক।

এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি সাভারের রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির কথা। ওই সময়ে অনেক তরুণ উদ্ধার কাজে এগিয়ে এসেছিল। আর এখনকার তরুণরা মানবিক দিকে অগ্রসর না হয়ে, তাদের একটি শ্রেণি জঙ্গিবাদের দীক্ষা নিচ্ছে। তারা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে। আজ আমাদের তরুণরা পথহারা, তারা দিকভ্রান্ত। তাদের সঠিক পথে আনতে হবে। এই আনার দায়িত্ব কে নেবে। বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেনথ 'বাঙালির সঠিক ইতিহাস নাই, ইতিহাস কে লিখিবে, আপনি লিখিবেন আমি লিখিব, আমরা লিখিব।' ঠিক তেমনি অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কে রুখে দাঁড়াবে। কে বন্যাকবলিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে? আপনি দাঁড়াবেন, আমি দাঁড়াব, আমরা দাঁড়াব, সমাজের সচেতন ও বিবেকবান সব মানুষ দাঁড়াবে। সত্য ও ন্যায়কে সঙ্গে নিয়ে সাহসের সঙ্গে আমাদের দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের।
মনে রাখতে হবে, ভীরু কাপুরুষের মতো, চোরের মতো এই সমাজে জীবনযাপন করে কোনো লাভ নেই। এখন প্রয়োজন সত্য ও ন্যায়ের জাগরণ, সাহসের জাগরণ। তা না হলে আমরা আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে পারব না। রক্ষা করতে পারব না সমাজের অসহায় হতদরিদ্র বন্যাকবলিত মানুষকেও।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের হতে হবে মানবিক এবং সেবার মানসিকতা আমাদের মধ্যে থাকতে হবে। বন্যাদুর্গত এলাকার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার মানবিক কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনে যদি আমরা উদাসীন থাকি, তা হলে উৎকৃষ্ট মানুষের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই।
সমাজ ও রাষ্ট্রের এই যে অসহিষ্ণুতা অনুদারতার ও অমানবিকতা-নিষ্ঠুরতার চিত্র, এই চিত্র পাল্টাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সাহসের সঙ্গে জীবন ঝুঁকি নিয়ে মানবিক বিপর্যয় রোধসহ যাবতীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। কাজটি কঠিন। কিন্তু কঠিনেরে আমরা ভালোবাসতে চাই। না হলে মানবতা গুমরে কাঁদবে পথে-প্রান্তরে।

সালাম সালেহ উদদীন : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সাম্প্রতিক