বেলাল হোসেন ঢালী
মারুবরা বিচের একটা বেঞ্চিতে একা বসে আছেন করিম স্যার। পশ্চিম দিগন্তে বিকেলের লাল সূর্যটা তার সবটুকু আলো ছড়িয়ে দিয়ে নীল সাগরকে রক্তজবা করে তুলেছে। পানির ওপর চমৎকার আলোর রশ্মি ঢেউয়ের দোলায় খেলা করছে।
পানির নিচে সূর্যের লাফালাফি। বিচের পানিতে মানুষগুলোর সাথে সূর্যটা যেন ঢেউয়ের তালে সাঁতার কাটছে। এত সুন্দর প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে। প্রায় প্রতিদিনই এ রকম দৃশ্য দেখেন করিম স্যার। এ আর নতুন কিছু নয় তাঁর কাছে। তার পরও আসেন। বসে থাকেন। বাসায় একা একা টিভি সেটের সামনে বসে আর কত! এখানে এলে অন্তত বিভিন্ন লোকের সাথে দেখা। ইয়াং ছেলে-মেয়েরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে, আদর করে-এসব দেখে মাঝেমধ্যে করিম স্যার নিজেকে নস্টালজিয়ায় হারিয়ে ফেলেন।
বেশি দিন আগের কথা নয়, করিম স্যারও প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় এসে সময়-সুযোগ হলেই স্ত্রীকে নিয়ে বিচের পাড়ে ঘোরাঘুরি করতেন। লোকচক্ষুর আড়াল হলে মাঝেমধ্যে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে দু-একটা কিস করতেন। জীবনের সেই ভালোবাসা ভালো লাগার দিনগুলো আজ রঙিন পর্দার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল।
এসব কথা মনে পড়তেই মনের অজান্তেই করিম স্যারের দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি টিসু দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে আবেগতাড়িত না হওয়ার জন্য তৈরি করেন আর ভাবেন, সেই স্ত্রী কী করে পারল তাঁর সাথে এমনটি করতে! না, চোখের পানি আর কোনো বাঁধ মানে না। লোকলজ্জা সবকিছু ভুলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেন প্রায়ই। এখন আর সে রকম হয় না। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফুরিয়ে মনটা এখন শক্ত পাথরের প্রতিকৃতি।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছাত্র ছিলেন করিম স্যার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন । ছাত্রজীবনে ক্লাসের অনেক মেয়েই তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ক্লাসমেট সমবয়সী স্মার্ট মেয়ের সাথে প্রেমে জড়াতে চাননি। টিউশনি করতে গিয়ে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া কাঁকণ নামের এক মেয়ের প্রেমে ফেঁসে যান। ফেঁসে যান বললে ভুল হবে, নিজে অনেক চিন্তাভাবনা করেই কাঁকণের প্রেমে সাড়া দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ। পাস করে বেরিয়ে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে কাঁকণকে বিয়ে করে ফেলেন। কারণ, করিম চান না, কাঁকণের মতো শান্ত ভদ্র সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ে হাতছাড়া হয়ে যাক।
কাঁকণ তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। করিম নিজে টিউটর দিলেও কাঁকণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাননি। বাধ্য হয়েই ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগরে।
কাঁকণকে বিয়ে করার সাথে সাথেই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে করিমের। বিয়ের পরপরই চাকরির প্রস্তাব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেন। করিম এখন করিম স্যার। শিক্ষকতার সুবাদে বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রী প্রায়ই বাসায় আসত তাদের প্রিয় করিম স্যারের কাছে পড়ালেখার প্রয়োজনে। ব্যাপারটা ভালো লাগত না কাঁকণের। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই বাগ্বিতণ্ডা হতো তাঁদের মাঝে। কাঁকণ চান না তাঁর স্বামীকে নিয়ে কোনো প্রকার স্ক্যান্ডাল ছড়াক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
করিম স্যারের মনটা আজ বেশি ভালো নেই। কারণ, বাড়ি থেকে আসার সময় স্ত্রী কাঁকণ বলে দিয়েছেন, তিনি যেন আর কোনো মেয়েকে টিউটর না দেন। তাই ক্লাস শেষে তাঁর রুমে ঢুকে মুড অফ করে বসে আছেন। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। এমন সময় রুমে ঢুকল পিয়ন।
- স্যার, আপনার চিঠি।
করিম স্যারের কোনো অনুভূতি নেই। পিয়ন বুঝতে পারল স্যারের মুড অফ। কিছু না বলে চিঠিটা রেখে চলে গেল। করিম স্যার অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিঠিটা খুলে পড়তেই খুশিতে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। একটা রিকশা নিয়ে সোজা বাসায় আসতেই আবার ফিরে গেলেন একটা ফুলের দোকানে। একমুঠো রজনীগন্ধা নিয়ে বাসায় এলেন। রজনীগন্ধা কাঁকণের খুব পছন্দ। কাঁকণ দরজা খুলতেই রজনীগন্ধার তোড়াটা কাঁকণের সামনে ধরলেন।
রজনী গন্ধা! ব্যাপারটা কী?
করিম স্যার কাঁকণকে জড়িয়ে ধরলেন।
কী ব্যাপার বলো তো?
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটিতে আমার পিএইচডির স্কলারশিপ হয়ে গেছে।
সত্যি?
এই দেখো, অফার লেটার।
কই দেখি দেখি। ও মাউ গড! কবে অ্যাপ্লাই করলে, আমাকে তো কিছুই...
মাস্টার্সের রেজাল্ট পাওয়ার সাথে সাথেই অ্যাপ্লাই করে রেখেছিলাম। এত সহজে হয়ে যাবে ভাবিনি। দ্যাটস অল ফর ইউ।
মি!
আফটার আই হ্যাভ মেরিড ইউ। আই হ্যাভ গট অল সাকসেস। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো মাচ।
আই লাভ ইউ টু। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় কয়েকটা গড়াগড়ি খেলো। করিম স্যার কাঁকণের গালে আদর দিয়ে বললেন-
সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে সবকিছুই ধরা দেয়।
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তুমি আবার বিদেশি মেয়েদের প্রেমে পড়ে সত্যিকার ভালোবাসাকে ভুলে যাবে না তো?
সে সম্ভাবনা আমাকে দিয়ে নেই।
হু, পুরুষ মানুষ। সুন্দরী মেয়ে দেখলে দুনিয়া ভুলে যায়। আর ভালোবাসা...
আমার ওপর এতটুকু বিশ্বাস অন্তত করতে পারো।
সরি, দুনিয়ায় কোনো পুরুষকে আমি অন্তত এ ব্যাপারে বিশ্বাস করি না।
করিম স্যার কাঁকণের কথাটাকে খুব সিরিয়াসলি নিলেন এবং মনে মনে ভাবছেন কী করা যায়। হঠাৎ অফার লেটারটা হাতে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন।
এটা তুমি কী করলে?
তোমার কথাটা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। যদি সত্যি সত্যি কারো প্রেমে পড়ে যাই তাহলে?
তাহলে? আমি তোমাকে কিচ্ছু বলব না। দেশে ডেকে এনে আদর করে বিষ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব। চিরঘুম।
এতটা ভালোবাসো আমাকে?
জানি না...
অফার লেটারটা ছেঁড়া নিয়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে প্রায়ই অনেক বাগ্বিতণ্ডা হতো। কাঁকণ অনেকবার বলেছে, সিডনি ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করে অফার লেটার হারিয়ে গেছে বলে আরেকটা লেটার এনে পিএইচডিটা করে আসতে। কিন্তু না, করিম স্যার নাছোড়বান্দা, একবার যেটা ছিঁড়েছেন, সেটা আর কিছুতেই ফেরত আনবেন না।
দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর কেটে গেল। কাঁকণ মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। করিম স্যার একদিন বাসায় এসে স্ত্রীকে বললেন-
তৈরি হয়ে নাও, আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।
কোথায়?
আহ, চলো না! সারপ্রাইজ।
করিম স্যার স্ত্রীকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনে গেলেন।
এখানে কেন?
আহ, দেখো না।
করিম স্যার এবং স্ত্রী কাঁকণ অস্ট্রেলিয়ার ভিসা নিয়ে একটা রিকশায় উঠলেন।
আচ্ছা, তুমি কেমন মানুষ? এত বড় একটা সুখবর আর তা কিনা এভাবে...
যেদিন আমার প্রথম অফার লেটারটা ছিঁড়ে ফেলি, সেদিনই আমি মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে রেখেছিলাম, অস্ট্রেলিয়ায় যদি পিএইচডি করতে যাই, তোমাকে সাথে নিয়ে যাব নয়তো নয়।
তুমি না, রিয়েলি একটা...
কী?
এতটা ভালোবাসো আমাকে?
জানি না...
পরম ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে করিম স্যার আর কাঁকণ নতুন স্বপ্ন আর উন্নত ভবিষ্যতের আশায় অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসেন।
করিম স্যার পিএইচডির পাশাপাশি ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দেন। কাঁকণ ইতিমধ্যে একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্মে ভালো একটা চাকরি পেয়েছেন। দুজনের আয়-ইনকাম খুবই ভালো। দুজনই বেশ হাই এডুকেটেট লোকজনের সাথে ওঠাবসা করেন।
সুখ, ভালোবাসা, অর্থ কোনো কিছুরই অভাব নেই তাঁদের সংসারে।
তিন ও পাঁচ বছরের মাথায় করিম স্যার আর কাঁকণের সংসারে আসে এক ছেলে আর এক মেয়ে। ইতিমধ্যেই করিম স্যারের পিএইচডি শেষ। তাঁরা দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন অস্ট্রেলিয়ার মতো এত সুন্দর দেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা এসব ছেড়ে তাঁরা আর বাংলাদেশে ফেরত যাবেন না। তাই পিএইচডি শেষ করেই অস্ট্রেলিয়া ইমিগ্রেশনে অ্যাপ্লাই করলেন পার্মানেন্ট রেসিডেন্টের জন্য। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি পেয়ে যান। করিম স্যারের জীবনে যেন ব্যর্থতার ছোঁয়া নেই। না চাইতেই সবকিছু আপনাআপনি হাজির হয়ে যায়। একেই বলে কপালের নাম গোপাল।
দেখতে দেখতে দিন ক্ষণ মাস বছর পেরিয়ে সময় অনেকটা গড়িয়েছে। ছেলে ও মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। দুজনই ইউনিভার্সিটি শেষ করে ভালো জব করে।
করিম স্যার চান দেশের সাথে সম্পর্কটা যেন একেবারে ছিন্ন হয়ে না যায়। তাই ছেলে ও মেয়েকে দেশে নিয়ে একটা ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে। কিন্তু না, ছেলে-মেয়ে দেশে বিয়ে করতে রাজি নয়। কারণ, তারা চায় এখানে জন্ম হয়েছে এমন ছেলে-মেয়েকে বিয়ে করতে । এতে ওদেরই-বা কী দোষ। বিয়ে করলেই তো হবে না, বাংলাদেশে জন্ম ছেলে-মেয়ের সাথে এখানের ছেলে-মেয়ের কতটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হবে, সেটা একটা বড় ব্যাপার। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করিম স্যারের ইচ্ছাটা আর পূরণ হলো না।
ছেলে-মেয়ে দুজনই তাদের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে। বিয়ের এক বছরের মাথায় ছেলে ও মেয়ে যার যার সংসার গোছাতে নতুন ইউনিট কিনে উঠে যায়। মাঝেমধ্যে উইকেন্ডে আসে মা-বাবাকে দেখতে।
দেখতে দেখতে করিম স্যারের বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। ইদানীং প্রায়ই আসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকেন। ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু কাঁকণ, কাঁকণের বয়স তাঁর যৌবনে ছাপ ফেলতে পারেনি। অনেকটা তেমনই রয়ে গেছে, যেমনটা ছিল ত্রিশ বছর আগে।
অফিস থেকে এসে করিম স্যার খুব টায়ার্ড থাকেন। ডিনার সেরে টিভিতে খবর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু তাই বলে কাঁকণের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। ইদানীং প্রায়ই কাঁকণ অফিসে বিভিন্ন মিটিং করে বাসায় ফিরতে দেরি করেন। এ নিয়ে করিম স্যারের তেমন কোনো কমপ্লেইন নেই। তিনি জানেন, এ দেশে বড় কোম্পানিগুলোয় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মিটিং থাকে।
করিম স্যার প্রতি রাতে স্ত্রী না আসা পর্যন্ত জেগে থাকতে চেষ্টা করেন। ঘুমিয়ে পড়লেও স্ত্রী আসার শব্দ পেলেই লাফ দিয়ে ওঠে যান। স্ত্রী খেয়ে এসেছেন কি না খোঁজখবর নেন। না খেয়ে থাকলে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করে টেবিলে দেন। নিজে না খেলেও স্ত্রীর পাশে বসে থাকেন।
ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রী শিশুদের মতো হয়ে যায়। একজন আরেজনকে ছাড়া চলে না। কিন্তু না। বুড়ো করিম স্যার এখন তাঁর স্ত্রীর কাছে একটা বোঝা। বাতিল মাল। মাঝেমধ্যে মন চায় গলা টিপে মেরে ফেলতে, কিন্তু পারেন না।
করিম স্যার তাঁর দুর্বলতাটা বুঝতে পারেন। তাই তো স্ত্রীর দেরি করে ফেরা নিয়ে কখনো প্রশ্ন করেন না। প্রায়ই কাঁকণের কলিগ ডেভিড কাঁকণকে লিফট দেন। গাড়ির শব্দে জানালার ব্লাইন্ডের ফাঁকা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেছেন, ডেভিড যাওয়ার সময় কাঁকণকে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কিস করে বিদায় নেন। সবকিছু দেখেও না দেখার, জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। স্ত্রীর সব অভিযোগ চুপ করে সহ্য করেন। যাতে এই শেষ বয়সে এসে এত বছরের সংসারটা ভেঙে না যায়।
কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলো না। শেষ পর্যন্ত এক রাতে ফোন করে কাঁকণ জানিয়ে দিলেন যে তিনি আর বাসায় ফিরবেন না। ডেভিড তাঁকে অনেক কেয়ার করে, তাই এখন থেকে তিনি ডেভিডের সাথেই থাকবেন। কঠিন বাস্তবতা আর হতাশার কুয়াশায় ঢেকে গেল করিম স্যারের এত বছরের সাজানো সংসার।
স্ত্রী কাঁকণের কথাটা শোনার পর করিম স্যারের পৃথিবীটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। হাত থেকে টেলিফোনটা পড়ে ঝুলতে থাকে। উত্তেজিত হবেন নাকি শান্ত হয়ে বসবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। আকস্মিকভাবে স্তব্ধ হয়ে যান। উঠে দাঁড়াতে চাইলেও আর উঠতে পারছেন না। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঘামে ভিজে গেছে। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছেন। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে মাটিতে পড়ে গেলেন। মাইল্ড স্ট্রোক। সে যাত্রা বেঁচে গেলেন। তবে তাঁর রিসার্চে আর আগের মতো মন দিতে পারেন না। ইউনিভার্সিটি তাঁকে দুই বছর আগেই অবসর দিয়ে দেয়।
রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটানো আর বুকের পাঁজরে লুকানো যন্ত্রণার বিষাদে করিম স্যারের পৃথিবী এখন সাহারা মরুভূমি।
অনেক দিন পর আজ আবার সেই পুরোনো জায়গা মারুবরা বিচের পাড়ে বেঞ্চিতে এসে বসেছেন করিম স্যার। হঠাৎ করে আকাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেল। সমুদ্রের নীল পানিতে আজ আর সূর্যটা খেলা করে না। করিম স্যারের আজ খুব শীত শীত লাগছে। একবার মনে হলো উঠে বাসায় চলে যাবেন। আবার ভাবেন, এতটা পথ হেঁটে এসেছি, একটু বসি।
বয়স এবং বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় নানা রকমের রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। শত চিকিৎসায় আর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছেন। তবুও বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকতে হয়। ইচ্ছে করলেই মানুষ কেন মরতে পারে না, এমন নানা প্রশ্ন করিম স্যারের মনে, কিন্তু কোনো উত্তর মেলে না। একবার ভাবেন, এ দেশে যদি ইউথানাসিয়ার পারমিশন থাকত তাহলে নিজের মৃত্যুর জন্য আবেদন করতেন। আবার ভাবেন, সমাজের মানুষ কী ভাববে। এই সমাজ, সমাজের লোকগুলো তো এখনো তাঁকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, সম্মান দেয়। এসব ভাবতে ভাবতে বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে পড়েন।
এই বিচে অনেক হোমলেস পিপল আছে। সন্ধ্যার পর সবাই যখন ঘরে ফিরে যায়, ওরা তখন বেঞ্চিতে রাতের জন্য নিজের বিছানা পাতে। তাই কেউ দেখেও ওদের ডিস্টার্ব করে না। কারণ, ওরা হোমলেস পিপল। মারুবরায় করিম স্যারের মিলিয়ন ডলারের হোম আছে কিন্তু হোমে থাকার পিপল নেই! পিপললেস হোম! কী বিচিত্র এই পৃথিবী!
মারুবরা বিচের সামনে বিশাল ফ্লেমেজ ইটারি ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক কুমিল্লার হক সাহেব। প্রতিদিন সকাল পাঁচটায় হক সাহেব তাঁর বাসা থেকে হেঁটে রেস্টুরেন্টে আসেন। প্রতিদিন রেস্টুরেন্ট খোলার আগে পুরো বিচটা অন্তত একটা চক্কর দিয়ে এসে রেস্টুরেন্ট খোলেন। এটা তাঁর প্রতিদিনের হাঁটার রুটিন। বিচে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পেলেন বেঞ্চের পাশে বালুতে একটা লোক শুয়ে আছে। অনেকেই বিচে এসে বালুতে এভাবে শুয়ে থাকে কিন্তু এত সকালে এই কনকনে শীতে কারো এভাবে শুয়ে থাকার কথা নয়! তাহলে? হক সাহেব একটু কাছে গিয়ে আঁতকে উঠলেন।
ও মাই গড! এ তো আমাদের করিম স্যার।
হক সাহেব বালুতে হাঁটু গেড়ে বসে তাড়াতাড়ি করিম স্যারকে ধরে বসালেন। কিন্তু না। একজন মৃত মানুষ, যাঁর দেহে কোনো প্রাণ নেই, প্রাণহীন এই মানুষটা কী করে বসে থাকবেন। করিম স্যারের দেহটা দুলে বালুতে পড়ে যাচ্ছে। হক সাহেব তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে করিম স্যারকে বুকে জড়িয়ে ধরে 'স্যার' বলে চিৎকার করে উঠলেন।
< Prev | Next > |
---|